গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ! বর্তমান ভারতে সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা বেড়েই চলেছে, বলছে রিপোর্ট
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: গত কয়েক বছরে ভারতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিজেপি জমানায় সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। ভারতে রাজনীতিকদের হাতে সাংবাদিকদের ‘আক্রান্ত’ হওয়ার ট্র্যাডিশন— মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে উত্তরে প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্য হুমকির ট্র্যাডিশন, নেতাকে নিয়ে অপ্রিয় খবর করার ‘অপরাধ’-এ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার ট্র্যাডিশন। ভারতীয় সাংবাদিকেরা এ-হেন পরিস্থিতিতে এখন আর অনভ্যস্ত নন, রাজনীতিকদের সাঙাত-শাগরেদ-বাহুবলীর মতো কায়মনোবাক্যের রক্ষীও তাঁদের প্রয়োজন হয় না, পেশাগত ও ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখেও সংবাদ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাই তাঁদের প্রথম ও শেষ রক্ষাকবচ। আসল দ্রষ্টব্য সাংবাদিকরা নন, রাজনীতিকরা— তাঁদের দমনযন্ত্রকুশলতার বিচিত্রতায়। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে—দিল্লির এমন একটি সংস্থা রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালিসিস গ্রুপ (আরআরএজি) জানিয়েছে, ২০২২ সালে ভারতে ১৯৪ সাংবাদিককে হেনস্তা করা হয়েছে। মারা গিয়েছেন অন্তত আটজন।
সাংবাদিকদের প্রধানত হেনস্তা করেছে রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সংস্থা এবং ‘ননস্টেট অ্যাক্টরস’ বা রাষ্ট্রবহির্ভূত বিভিন্ন সংগঠন। সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং পেশাদার অপরাধীরাও সাংবাদিকদের হেনস্তা করেছে বলে মঙ্গলবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে আরআরএজি।
গত বছর যে আট সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সাতজনকে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে হত্যা করা হয়েছে বলে আরআরএজির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। একজন সাংবাদিক—সুভাষকুমার মাহতোকে নির্দিষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য হত্যা করা হয়েছে।
জম্মু-কাশ্মীর, মণিপুর এবং নকশাল–প্রভাবিত এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠী প্রায় ৪১ জন সাংবাদিককে ‘টার্গেট’ করে। তাঁদের মধ্যে রোহিত বিসওয়াল নামের এক সাংবাদিক খবর সংগ্রহের সময়ে কথিত মাওবাদী–নিয়ন্ত্রিত একটি ‘ইম্প্রভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ বিস্ফোরণে নিহত হন।
আরআরএজির পরিচালক সুহাস চাকমা বলেছেন, ‘সংবাদবিষয়ক স্বাধীনতার যে পরিস্থিতি, তার উন্নতি (২০২২ সালে) হয়নি। অনলাইন এবং অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তি সাংবাদিকদের আক্রমণ করেছে।’
রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীরের সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি হেনস্তা করা হয়েছে। অন্তত ৪৮টি ক্ষেত্রে তাদের ‘টার্গেট’ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আরআরএজি। এরপরই স্থান পেয়েছে তেলেঙ্গানা রাজ্য, যেখানে ৪০টি ঘটনা ঘটেছে। এর পরে যথাক্রমে রয়েছে ওডিশা (১৪), উত্তর প্রদেশ (১৩), দিল্লি (১২)।
মধ্যপ্রদেশ ও মণিপুরে ছয়টি, অসম ও মহারাষ্ট্রে পাঁচটি, বিহার, কর্ণাটক ও পাঞ্জাবে চারটি, ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড ও মেঘালয়ে প্রতিটিতে তিনটি, অরুণাচল প্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে দুটি এবং অন্ধ্র প্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানা, পদুচেরি, রাজস্থান, ত্রিপুরা ও উত্তরাখন্ডের প্রতিটিতে অন্তত একটি ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ‘টার্গেট’ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
রাষ্ট্র অন্তত ১০৩ জন সাংবাদিককে হেনস্তা করার পাশাপাশি, রাষ্ট্রবহির্ভূত বিভিন্ন সংগঠন ‘টার্গেট’ করেছে ৯১ জনকে। রাষ্ট্র যে ১০৩ জন সাংবাদিককে হেনস্তা করেছে, তাদের মধ্যে ৭০ জনকে গ্রেপ্তার অথবা স্বল্প সময়ের জন্য আটক করা হয়েছে। ১৪ জন সাংবাদিকের নামে পুলিশে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া, কমপক্ষে ১৫ জন সাংবাদিককে পুলিশ-সহ সরকারি কর্মকর্তারা শারীরিকভাবে আক্রমণ বা শ্লীলতাহানি করেছেন, হুমকি দিয়েছেন বা হয়রানি করেছেন বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
অন্তত চারজন সিনিয়র সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে আছেন জম্মু-কাশ্মীরের গওহর জিলানি ও যশরাজ শর্মা এবং মণিপুরের ওয়াংখেমচা শামজাই। তাঁদের পুলিশ জেরা করে। মহারাষ্ট্রের বাণিজ্য বিষয়ক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সুচেতা দালালকে জেরা করে দিল্লির এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। অন্তত তিনজন সাংবাদিক, যেমন জম্মু-কাশ্মীরের আকাশ হুসেন, সান্না ইরশাদ মাট্টু এবং মহারাষ্ট্রের রানা আইয়ুবকে বিদেশে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছিল।
রাষ্ট্রবহির্ভূত বিভিন্ন সংগঠনের হাতে যে ৯১ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রয়েছেন ওডিশা ও উত্তর প্রদেশে। দুই জায়গাতেই অন্তত পাঁচজন সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছেন।