অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নে মোদী সরকারের অতি-তৎপরতা নিয়ে শঙ্কায় RSS
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নে সরকার যে কতটা তৎপর, খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। মঙ্গলবার মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালে বিজেপি কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরিবারের প্রত্যেকের জন্য আলাদা নিয়ম থাকলে যেমন সংসার চালানো যায় না, তেমনই দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা আলাদা আইন থাকলে দেশ চালানো কঠিন হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর থেকেই তোলপাড় গোটা দেশ। মোদীর এই বক্তব্যের পরেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড জরুরী ভিত্তিতে মিটিংয়ে বসে পড়ে। গভীর রাতে মিটিং শুরু করে দেন তারা। দীর্ঘ আলোচনা চলে তাঁদের মধ্যে। পরে তাঁরা জানিয়েছেন, একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একটি খসড়া তৈরি করা হবে। সেখানে শারিয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা থাকবে। কেন এটা প্রয়োজন সেটা বলা হবে। ল কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে এই খসড়াটা জমা দেওয়ার জন্য সময় চাওয়া হবে।
এবার বিজেপির অভ্যন্তরেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ভোটের আগে এ নিয়ে জোরাজুরি করাটা শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হয়ে উঠবে কি না। কারণ, বিজেপি যাদের নতুন করে কাছে টেনে জোটবদ্ধ হতে চাইছে, তাদের মতো বিরোধীরাও মনে করছে, এই বিধি হিন্দুসমাজকেও বিভাজিত করবে। বিরোধীদের দাবি, বিজেপি আগে সব জাত ও শ্রেণির হিন্দুর জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করুক, তারপর অন্য ধর্মাবলম্বীদের দিকে তাকাক।
কিছুদিন আগে দেশের ২২তম আইন কমিশন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের জন্য সব ধর্মাবলম্বীর মতামত জানতে চায়। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সংগঠনদের অভিমতও জানতে চাওয়া হয়। জুলাই মাসের মাঝামাঝি নাগাদ সবাইকে এই বিষয়ে মতামত জানাতে বলা হয়েছে। বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদীরা ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার শুরু করে দিয়েছে। আইন কমিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে এখনই সাড়ে আট লাখের বেশি পরামর্শ জমা পড়েছে।
ভোটের আগে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অতিসক্রিয়তায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) কিছুটা চিন্তিত। তাদের চিন্তার কারণ, জনজাতি সমাজ এবং অন্য সংখ্যালঘুরা। বিশেষ করে দেশের বিস্তীর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে তারা ভাবিত। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে জনজাতির সমাজের উপস্থিতি বিরাট। এই নীতি নির্বাচনী ইস্যু হয়ে দাঁড়ালে বিরোধীরা সেখানে ফায়দা তুলতে পারে, বিশেষ করে মূল্যবৃদ্ধি ও কর্মহীনতার দরুন জনজাতি সমাজ যখন ব্যতিব্যস্ত। তা ছাড়া কোনও কোনও জনজাতি সমাজে মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তাতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। দেশে জনজাতিদের জন্য ৫০টির মতো লোকসভা আসন সংরক্ষিত। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বিরোধী প্রচারে সেখানে ভিন্ন প্রভাব পড়লে বিজেপির পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে বলে সংঘের আশঙ্কা।
বিজেপি নীতিগতভাবে সব সময়ই যে তিনটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে, তার অন্যতম এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। অন্য দুটি বিষয় ইতিমধ্যেই তারা আয়ত্ত করে ফেলেছে। অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরির কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। জম্মু–কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ৩৭০ অনুচ্ছেদও তারা খারিজ করে দিয়েছে। বাকি রয়েছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। যদিও দেশের সংবিধানপ্রণেতারা কিন্তু বুঝেছিলেন, ভারতের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বহুধর্ম, ভাষা ও প্রথার দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন নানান অশান্তি ও অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। সে কারণেই ঐকমত্য স্থাপনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। ২১তম আইন কমিশনও বলেছিল, এখনই এর প্রয়োজন নেই।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন,মধ্যপ্রদেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রসঙ্গ তোলাও তাৎপর্যপূর্ণ। এই রাজ্যে চলতি বছরের শেষে ভোট। সেখানে শাসক বিজেপির হালও বেশ নড়বড়ে। মনে করা হচ্ছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রসঙ্গ তুলে মোদী সেখানে হিন্দুদের জোটবদ্ধ করতে চাইছেন।
তবে, আরএসএসের শঙ্কা, এতে হিতে বিপরীত হলে শোধরানোর অবকাশ পাওয়া যাবে না। তাই বিজেপিকে তারা সতর্ক পদচারণের পরামর্শ দিয়েছে। খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, পারসি, জৈন, শিখ ও বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের প্রতিক্রিয়া ভালোভাবে বোঝার ওপর জোর দিয়েছে।