আজ ২৯ জুলাই বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবস, কেমন ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের শেষ দিন?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: যে মানুষটি জগতকে আলো দেখিয়ে গেলেন, তাঁর নিজের জীবন ছিল আঁধারে ডোবা। একেবারে নিঃসঙ্গ। প্রদীপের তলায় যেমন অন্ধকার থাকে বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনটিও ঠিক তাই। বিদ্যাসাগরের শেষ জীবন মোটেও সুখকর ছিল না। জ্যেষ্ঠ সন্তান তথা একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রের প্রতি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, তিনি নারায়ণচন্দ্রকে ১৮৭২ সালে ত্যাজ্য পুত্র করেন। কিছু দিন পরই স্ত্রী দীনময়ী দেবীর মৃত্যু হয়। স্ত্রীর শ্রাদ্ধেও বাড়ি যাননি বিদ্যাসাগর। বাবা কাশীবাসী। ১৮৭১-এ মা সেখানেই কলেরায় মারা গিয়েছেন। নিঃসঙ্গ বিদ্যাসাগর নির্জনতার জন্যে আকুল হয়ে উঠেছিলেন। বিদ্যাসাগর নাগরিক জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেছে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছা নির্বাসন। তাঁকে রক্তাক্ত করেছে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, ইংরেজ শাসক, শাসকের করুণালোভী জমিদার শ্রেণি, বাবু সম্প্রদায়, এমনকী জননীও ক্ষত-বিক্ষত করেছেন তাঁকে। জীবনের শেষ বাইশ বছর প্রাণাধিক প্রিয় বীরসিংহ গ্রামে পা ফেলেননি তিনি।
মানুষের কাজ করতে করতে ঋণে জর্জরিত হয়েছেন, খুইয়েছেন সর্বস্ব। শেষ জীবনে শান্তির খোঁজে (বর্তমান ঝাড়খণ্ডে) কার্মাটাঁড়ে স্টেশনের কাছে ৫০০ টাকায় স্থানীয় এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে আমবাগান সমেত প্রায় ১৪ বিঘা জায়গা কেনেন। জামতাড়া ও মধুপুরের মাঝে ছোট্ট স্টেশন কার্মাটাঁড়। সেখানে মূলত সাঁওতালদের বাস। শান্তির জন্য সেখানেই একটি ছোট্ট বাড়ি তৈরি করেছিলেন বিদ্যাসাগর। নাম দিয়েছিলেন নন্দনকানন। সরল প্রাণবন্ত মানুষের মাঝে কিছুটা শান্তি পেয়েওছিলেন। বিদেশ থেকে হোমিয়োপ্যাথির বই আনিয়ে তা পড়ে তাঁদের চিকিৎসা করতেন। রাতের স্কুল চালানোর জন্য মাঝখানে একটি হলঘর, একপাশে ঘর, অন্যপাশে পড়ার ঘর। নিজের হাতে বুনেছিলেন একটি কিষাণভোগ আমগাছ। বাগানের দেখভালের জন্য কালী মণ্ডল নামে এক মালিও ছিল তাঁর। কালীকে দিয়ে বাগানের শেষ প্রান্তে লাগিয়েছিলেন একটি ভাগলপুরি ল্যাংড়া আমগাছ। কার্মাটাঁড়ে বসেই তিনি সীতার বনবাস লিখেছেন, বর্ণপরিচয়ের তৃতীয় সংস্করণের প্রুফ দেখেছেন।
সরল আদিবাসী মানুষের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র, দলে দলে সাঁওতালেরা বিদ্যাসাগরের কাছে ভুট্টা বিক্রি করতে আসতেন। বিদ্যাসাগর ভুট্টা কিনে ঘরে রাখতেন। আবার কাজ শেষে সাঁওতালেরা যখন বিকেলে ঘরে ফেরার পথে বিদ্যাসাগরের কাছে খেতে চাইতেন। ওদের থেকে কিনে রাখা ভুট্টাই খেতে দিতেন বিদ্যাসাগর। সাঁওতালদের সঙ্গে বসে বিদ্যাসাগর নিজেও সেই ভুট্টা পুড়িয়ে খেতেন। আদিবাসীদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে তাঁদের কাছে জীবনদাতা ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেখানে মেথরপল্লিতে তিনি নিজের হাতে কলেরা রোগীর সেবা করেছেন। প্রতি বছর পুজোর সময়ে তিনি তাঁদের জন্য জামাকাপড় কিনতেন। শীতে কার্মাটাঁড়ে প্রচন্ড ঠান্ডা থাকত। বিদ্যাসাগর তখন মোটা চাদর কিনে গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন। কখনও কলকাতা গেলে তাঁদের জন্য বিভিন্ন রকম ফল নিয়ে আসতেন।
বিদ্যাসাগরের রুটিন ছিল সকাল দশটা পর্যন্ত সাঁওতালদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করা। পথ্য হিসেবে সাগু, বাতাসা, মিছরি ইত্যাদি দেওয়া। দুপুরে পীড়িত সাঁওতালদের কুটিরে গিয়ে দেখভাল করা। আরণ্যক সাঁওতালদের সরল জীবনযাত্রা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। কার্মাটাঁড়ের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ছিল প্রায় ১৭ বছরের। শরীরস্বাস্থ্যের ভগ্নদশার কারণে ১৮৯০-এর গোড়া থেকে আর কার্মাটাঁড়ে থাকেননি বিদ্যাসাগর। কার্মাটাঁড় স্টেশনের সঙ্গেও তাঁর নানান স্মৃতি জড়িত। এখন কার্মাটাঁড়ের নাম বিদ্যাসাগর। রেল স্টেশনটির নামও বিদ্যাসাগর।
অসুখের শুরু অনেকদিন হলেও প্রথম আঁচড় কেটেছিল ১৮৬৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। উত্তরপাড়ায় মেয়েদের একটি স্কুল দেখে ফিরছেন বিদ্যাসাগর। বালি স্টেশনের কাছে যে গাড়িতে বিদ্যাসাগর ছিলেন সেটা হঠাৎ উলটে গেল। ছিটকে পড়ে প্রচণ্ড আঘাত লাগল, অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি। কলকাতায় আনা হলে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার জানালেন, লিভারে প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে ও অ্যাবসেস দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর ব্যথা কিছু কমলেও আর কোনদিনই সুস্থ হননি তিনি। ১৮৯১ সালে তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবেও লেখা হয়েছিল লিভারে ক্যানসার।
কিন্তু কলম বা কাজ, কোনটাই থামেনি। ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত পেল ভ্রান্তিবিলাস। ১৮৭০ সালে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগে তৈরি হল ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’, সেখানে এক হাজার টাকা দান করলেন বিদ্যাসাগর।
শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই কলকাতার বাদুড়বাগানের বাড়ি ছেড়ে তিনি মাঝে মাঝে চন্দননগরে, গঙ্গার পাড়ের এক ভাড়া বাড়িতে গিয়ে থাকেন। ১৮৯১ সালের জুন মাস, পাকাপাকিভাবে বাদুড়বাগানের বাড়িতে ফিরলেন বিদ্যাসাগর। প্রবল যন্ত্রণায় কাতর দয়ারসাগর। ইংরেজ ডাক্তার বার্চ ও ম্যাকনেল ক্যান্সার সন্দেহ করে চিকিৎসার ভার নিতে রাজি হলেন না। দেখতে লাগলেন ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার। ১৮৯১-এর ২৯শে জুলাই রাত এগারোটার পর আর তাঁর নাড়ি পাওয়া যায়নি। রাত দুটো বেজে আঠেরো মিনিট। চোখ খুললেন, তারপর চিরতরে বন্ধ হল দু’টি চোখ। একটা হাত এসে পড়ল কপালে।