বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

বাঙালির মনসা পুজো ও মনসামঙ্গলে চাঁদস‌ওদাগরের ইতিবৃত্ত

August 19, 2023 | 4 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাঙালির কাছে মনসা দেবী সর্পদেবী হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ আবার এই দেবীকে বিষহরি‌ও বলে থাকেন। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে বাংলায় দেবী মনসার পুজো প্রচলিত।

পদ্মপূরাণ এবং মনসামঙ্গল অনুসারে, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এক অনন্যা দেবী মনসা। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যিনি পিতৃসংহার, মাতৃসংহার এবং স্বামীকে সংহার করতে চান। মনসামঙ্গল কাব্য থেকে জানা যায়, বেহুলা বাঙালী নারীর আরেক সতীসাধ্বী চরিত্র। যিনি শেষ পর্যন্ত লখিন্দরকে দংশন করে দাম্ভিক চাঁদ সওদাগরকে পূজা দিতে বাধ্য করেন ।

কেতকাদাসের কাব্যে চাঁদ বান্যা বলেছে—

‘যাহা সনে করি আমি বাদ বিসম্বাদ। তার শরণ লব এ বড় প্রমাদ ৷৷

চেঙ্গমুড়ি কানি বলি যারে দিল গালি। কোন্ লাজে তাহারে হইব পুটাঞ্জলি ৷৷

মরণ অধিক লজ্জা মস্তক-মুন্ডন। মনসা পূজিতে মোর নাহি লয় মন ৷৷

যেই হাথে পজি সোনার গন্ধেশ্বরী। কেমনে পূজিব তায় জয় বিষহরি ।।

সাবিত্ৰী সমান হৈল পুত্রবধূ মোর ঘরেচে পাইলু বস্যা চৌদ্দ মধুকর ।।

হেন মনসার পূজা নাঞি করি যদি। বিপাকে হারাই পাছে পায়্যা পঞ্চনিধি ৷৷

মনসামঙ্গলে মনসাদেবীর ইতিবৃত্ত

শিব ঠাকুর একবার প্রমোদ ভ্রমনে বেরিয়েছেন। তখন বসন্তকাল। ভ্রমনে হঠাৎ করেই তাঁর কামভাব জাগ্রত হয়েছে। তখন তাঁর বীর্য স্খলন হয়ে পড়ে মাটিতে। ধরিত্রী তখন বলল, এত শক্তিশালী জিনিস আমি ধারণ করতে পারব না। তখন তা পদ্মবনে ফেলা হয়। সেখানে পড়ার পরই পূর্ণ যৌবনা একটি মেয়ে বেরিয়ে আসে। শিবের ঔরসে জন্ম। কিন্তু জন্ম মাতৃগর্ভে না। জন্ম হয়েছে পদ্মবনে। সেই জন্যে মনসার আরেক নাম হচ্ছে পদ্ম বা পদ্মাবতী। শিব একই পথে ফিরে আসার সময় দেখেন, অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে। শিবের তো বদদোষ ছিল। তার কাছে প্রণয় নিবেদন করলে, মনসা খুব রেগে যায় এবং পিতাকে খুব বকাবকি করে। তখন শিব ঠাকুর ক্ষমা চেয়ে চলে যান। তখন মনসা দৌঁড়ে গিয়ে বলেন, আমাকে কোথায় রেখে যাচ্ছ? আমিতো তোমার সন্তান। আমাকে যে জন্ম দিলে, আমি তোমার মেয়ে না? আমাকে নিয়ে যাও। মহা বিপত্তিতে পড়লেন শিব। এক পর্যায়ে সঙ্গে নিলেন। স্ত্রী দুর্গার ভয়ে ঘরের মধ্যে নিয়ে ফুলের টুকরি দিয়ে চাপা দিয়ে লুকিয়ে রাখেন অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে। দুর্গা ভিতরে এসে শোনেন, ঘরে নারী কণ্ঠের চিৎকার।

আমি তোমার মেয়ে। তুমি আমাকে এ ভাবে চাপা দিয়ে রাখছো কেনো?
মেয়ে? কোত্থেকে তুই মেয়ে? বের হ এখান থেকে? বলে রাগান্বিত শিব।
না। আমি এখান থেকে যাব না। এটা আমার পিতারর বাড়ি।

দুর্গা এসব শুনে মারতে শুরু করলেন মনসাকে। মারতে মারতে তার একচোখ কানা করে দিলেন। তখন মনসা আত্মরক্ষার জন্য একটা পাল্টা আঘাত করল। তাতেই দুর্গার অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়। ত্রিভুবনে হাহাকার পড়ে গেল। দেবলোকে হাহাকার পড়ে গেল। সবাই এসে বকাবকি করে। বলে, মাতৃঘাতিনী। গালাগালি চলতেই থাকল। তখন নারদ এসে বিষ সংহরণ করলেন। তাঁর যে আঘাত বিষাক্ত। তাঁর জন্ম কোথায়? জন্ম হচ্ছে মৃত্তিকাগর্ভে।

এরকম একটা বিবাদের ঘটনা ঘটল শিবের সঙ্গেও। মেয়ের সঙ্গে পিতার বিবাদ লাগল। শিবও তাকে খুব মারধর করলেন। মার ঠেকাতে গিয়ে শিবের গায়ে আঘাত লাগল। শিব‌ও ব্যাথা পেলেন। তখন আবার দেবলোকে হাহাকার পড়ে গেল। সবাই এসে তাকে গালাগালি করতে লাগল। তখন শিব নিজে সেই বিষ সংহরণ করলেন। তারপর দেবলোকে ভাবা হলো, এ মেয়েকে ঘরে রাখা যায় না। তখন মুনি জরৎকারু শিবপূজার ধ্যানে বসেছেন, কিন্তু ধ্যান পৌঁছায় না। সিদ্ধি লাভ হয় না। কেন হয় না? যেহেতু তাঁর পূর্বপুরুষরা শ্রাদ্ধ পায়নি, সে জন্য তাঁরা ত্রিশঙ্কাতে আছে। স্বর্গেও যায় না, নরকেও যায় না। কারণ তিনি শ্রাদ্ধ করতে পারেন না। শ্রাদ্ধ সেই করতে পারে, যে বিয়ে করেছে, সন্তানের পিতা হয়েছে।

তখন ভাবলেন, আমাকে তো বিয়ে করতে হবে। কিন্তু বয়সতো আর থেমে নেই। এ বয়সে মেয়ে কোথায় পাওয়া যায়? তখন শুনলেন, শিবের এক মেয়ে আছে। সেখানে বলা হলে শিব রাজি হয়ে গেলেন, দুর্গা রাজি হয়ে গেলেন। বিয়ে হয়ে গেল বৃদ্ধ জরৎকারু মুনির সঙ্গে। বিয়ের পর নিয়ে এসেছেন ঘরে। এরপরে স্বামী জরৎকারু মুনির সাথেও মনসার বিবাদ বাঁধে। শেষে মনসাকে মারতে শুরু করলেন তিনি। পাল্টা মার খেয়ে জরৎকারু মুনির অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়ে। তখন সে হয়ে যাচ্ছে পিতৃঘাতিনী, মাতৃঘাতিনী, স্বামীঘাতিনী। দেবকুল ভাবলেন একে তো ঘরে রাখা যায় না। নির্বাসনে পাঠাতে হয়। তাঁকে বনে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হলো। গহীন অরণ্যে কেঁদে বেড়ায় মনসা। তখন মাটির তলার অষ্টনাগ উঠে আসে। বলেন মা, তুমি কাঁদছ কেন?
বলে, আমার কেউ নেই।

নাগ বলে, আমিই তো তোমার সন্তান। তখন সাপের লেজ পায়ের খাড়– হয়, হাতের বালা হয়, গলার মালা হয়, মুকুট হয়। এই অষ্টনাগ নিয়ে দেবদেবীর যদি পূজা পাবার অধিকার থাকে, তবে আমিও দেবকন্যা, আমারও পূজা পাওয়ার অধিকার আছে। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে মনসা প্রথম গেল চণ্ডালদের কাছে। চণ্ডালরা তাকে মাথা পেতে গ্রহণ করল। গেল কৃষকদের কাছে। কৃষকরা তাঁকে তুলে নিল। গেল তাঁতি, জেলেদের কাছে। তাঁরা তাদের অধিকার দিল। কিন্তু সম্পদশালী চাঁদ সওদাগর তাকে পূজা দিতে রাজি হয়নি। তাঁকে কানি বলে গালাগালি করেন। এখানেই শুরু হয় বিবাদ।

চম্পক নগরের অধীশ্বর বণিক চাঁদ সদাগর। দেবাদিদেব শিবের মহাভক্ত। চাঁদ জগতপিতা শিবের থেকে মহাজ্ঞান লাভ করেছেন। মনসা জানেন মানুষের পূজা ব্যতীত দেবত্ব অর্জন সম্ভব নয়; তাই তিনি চাঁদের কাছে পূজা চাইলেন। কিন্তু শিব ছাড়্ অন্য কাউকে পূজা করতে চাঁদ সওদাগর প্রত্যাখ্যান করলেন। এমনকী সওদাগর পত্নী মনসার ঘটে হেঁতালদন্ডের বাড়ি মারেন। পরিণামে মনসা কৌশলে চাঁদের মহাজ্ঞান হরণ করেন এবং ছয়পুত্রকে বিষ দিয়ে হত্যা করেন। তারপর সমুদ্রপথে চাঁদের বাণিজ্যতরী সপ্তডিঙা মধুকর ডুবিয়ে চাঁদকে সর্বস্বান্ত করেন। চাঁদ কোনক্রমে প্রাণরক্ষা করেন। মনসা ছলনা করে স্বর্গের নর্তকদম্পতি অনিরুদ্ধ-ঊষাকে মর্ত্যে পাঠালেন। অনিরুদ্ধ চাঁদের ঘরে জন্মাল লখিন্দর রূপে, আর উজানী শহরে সাধু-বণিকের ঘরে বেহুলা রুপে ঊষা জন্ম নিল। বহুকাল পর চাঁদ সহায়-সম্বলহীনভাবে চম্পক নগরে পাগল বেশে গেলেন । অবশেষে পিতা-পুত্রের মিলন ঘটল। বেহুলার সাথে লখিন্দরের বিয়ে স্থির হল। মনসা বৃদ্ধাবেশে এসে ছল করে বেহুলাকে শাপ দিল, “বিভা রাতে খাইবা ভাতার।” মানে বাসর রাতে স্বামী হারাবে। চাঁদসওদাগর পুত্র লখিন্দরের জন্য সাতালি পর্বতে লোহার বাসরঘর বানালেন। কিন্তু রাজমিস্ত্রীকে মনসা স্বপ্নে দেখালেন ভয় ফলে গোপনে মনসার নির্দেশে একটি ছিদ্র রাখতে বাধ্য হলেন রাজমিস্ত্রী। আর সেই ছিদ্র পথে বাসররাতে কালনাগিনী ঢুকে লখাইকে দংশন করল। বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে কলার ভেলায় ভেসে কালিদহ সাগর পাড়ি দিল মনসার উদ্দেশ্যে।

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ বর্ণিত বেহুলা তাঁর জীবনের এই পরিণতিকে মেনে নেননি। লখিন্দরের জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য জলে তার মান্দাস ভাসিয়েছে। বেহুলা তার দাদাকে বলেছেন—

‘…আমি হই কড়হা রাড়ী। কত না পেলাব আর নিরামিষ্য হাঁড়ি।।
মা বাপের বাড়ী মোরে আর নাহি সাজে।/ সকল ভাউজ সঙ্গে নিত্য দ্বন্দ্ব বাজে ।।

নারিব সহিতে আমি দুরাক্ষর বাণী। রপথে বহু বিপদ অতিক্রম করে অবশেষে নেতো ধোবানির সাহায্যে দেবপুরে পৌঁছে নাচের মাধ্যমে দেবতাদের তুষ্ট করলেন বেহুলা। তখন দেবতাদের আদেশে মনসা লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন। বেহুলার সতীত্বের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে অবশেষে চাঁদ সওদাগর মনসার পুজো দিলেন। মর্ত্যবাসের মেয়াদ ফুরাতে বেহুলা-লখিন্দর আবার ইন্দ্রসভায় স্থান পেলেন।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Manasa Puja, #manasamangal

আরো দেখুন