আবার হরিয়ানায় ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ, ‘নেটবন্দি’তে শীর্ষে মোদীর ভারত?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: হরিয়ানা জ্বলছে, হরিয়ানার নূহ জেলায় অস্থায়ীভাবে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে। নূহ জেলার এসপি জানিয়েছেন, তাঁর জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা থেকে ১৬ সেপ্টম্বর রাত ১১টা ৫৯ পর্যন্ত নেট পরিষেবা বন্ধ থাকবে সেখানে। আদপে মোদী সরকার যেকোনও সমস্যায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার অস্ত্র ব্যবহার করে, মণিপুরেও একই জিনিস ঘটেছে।
মোদী আমলে গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নেট বন্দি হয়েছে ভারতে, বিগত এক বছরে ইউক্রেনের চেয়েও তিনগুণ বেশি বার ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছে ভারতে। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যাহত হয় ভারতে, গত পাঁচ বছরের হিসেব সে’কথা বলে। ইন্টারনেট পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিধিনিষেধকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের নামে ছেদ পড়ে ইন্টারনেট পরিষেবায়। সম্প্রতি উত্তাল মণিপুর, সেখানে দুই জনজাতি সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে বন্ধ ইন্টারনেট পরিষেবা। ২০২০ সালে দেশের শীর্ষ আদালত, ইন্টারনেট বন্ধের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশিকা জারি করেছিল। কোন পরিস্থিতিতে, কী মাত্রায় ইন্টারনেট পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ করা হবে, কীভাবে হবে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি, সে’সব কিছু না মেনেই মোদী সরকার যত্রতত্র ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।
ইন্টারনেট অধিকার নিয়ে সওয়াল করা আইনজীবী থেকে আরম্ভ করে সাইবার বিশেষজ্ঞরা, সকলেই অভিযোগ করছেন, সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশিকাগুলির প্রকাশ্য লঙ্ঘন করে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়ে বিচার বিভাগ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে, এমনটা হলে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া চালিয়ে যাবে।
অনুরাধা ভাসিন মামলায়, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, অনুরাধা ভাসিন বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিমকোর্ট প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে ইন্টারনেট পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি বিশদ নির্দেশিকা দেয়। ৩৭০ বিলোপের সময়, ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে জম্মু-কাশ্মীরে, অনির্দিষ্টকালের জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই মামলা হয়।
সুপ্রিমকোর্ট কাশ্মীরে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ প্রত্যাহার করেনি, তবে পর্যবেক্ষণে জানিয়েছিল ভারতীয় আইন ইন্টারনেট পরিষেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখার অনুমতি দেয় না এবং ইন্টারনেট বন্ধের আদেশগুলি বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনা সাপেক্ষ।
উল্লেখ্য, ১৪৪ ধারা অনুযায়ী (ক্রিমিনাল পেনাল কোড, ১৯৭৩) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার ক্ষমতাবলে আপদকালীন অবস্থায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের নির্দেশ দিতে পারেন। ২০১৭ সালে ইন্ডিয়ান টেলিগ্রাফ আইন,১৮৮৫ আইনে বদল আনে মোদী সরকার। যার সাহায্যে উচ্চপদস্থ আমলারা, টেলিকম ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ তথা নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিতে পারেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তা করা যাবে, তাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। জনসাধারণের জরুরিক্ষেত্রে, জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, ভারতের সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হলে, আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য, বিদেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বা অপরাধের প্ররোচনা রোধ করার জন্য। বলা হয়েছিল আদেশ লিখিতভাবে জারি করতে হবে, নির্দেশের কারণসহ। পাঁচ দিনের মধ্যে, তিন আমলা নিয়ে গঠিত একটি কমিটি তা পর্যালোচনা করবে। কিন্তু এসব কিছুই মানা হয় না।
২০১৭ সালের নিয়মে, ২০২০ সালে সংশোধন আনা হয়। বলা হয়, ১৫ দিনের বেশি ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু মণিপুরে, এখন ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে প্রায় ৬০ দিনেরও বেশি সময় ধরে। প্রতি পাঁচ দিন পর পর পুনরায় বন্ধ করার আদেশ জারি করা হচ্ছে। ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন, একটি বেসরকারী সংস্থা যা ডিজিটাল অধিকার এবং স্বাধীনতার বিষয়ে লড়াই করে, তারা বলছে মণিপুর ইন্টারনেট বন্ধ করে দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশিকাকে স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে৷ তাদের দাবি, ভারতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশিকা মানা হয় না। এশিয়া প্যাসিফিক পলিসি কাউন্সেল অ্যাকসেস নাও, একটি অলাভজনক সংস্থা যারা বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে নজর রাখে, তাদের মতে; ২০২২ সালে বিশ্বের সমস্ত ইন্টারনেট বন্ধের ৪৪.৯%, ২০২১ সালে সমস্ত ইন্টারনেট বিভ্রাটের ৫৮.১% এবং ২০২০ সালে নথিভুক্ত সব ইন্টারনেট বন্ধের ৬৮.৫% ভারতে হয়েছে৷
দুই সংস্থা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এবং ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের জুনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি, ২০২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত ১২৭ বার ভারতের কোনও না কোনও প্রান্তে ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে বিক্ষোভের জন্য ৫৪ বার, পরীক্ষায় জালিয়াতি রুখতে ৩৭ বার, সাম্প্রদায়িক হিংসতার কারণে ১৮ এবং আইন-শৃঙ্খলার উদ্বেগের জন্য ১৮ বার ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরে কমপক্ষে ২৮০ ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছে। দেশের সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীরে সর্বাধিক ইন্টারনেট বন্ধ থেকেছে৷
শীর্ষ আদালতের নির্দেশ না মানা হলেও, নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গিয়েছে আদালত। মার্চ মাসে স্কুল পরীক্ষার সময় জালিয়াতি রুখতে রাজ্য সরকার কর্তৃক ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ প্রত্যাহার করে কলকাতা হাইকোর্ট। এহেন প্রেক্ষিতে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ ভবিষ্যতে ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আদালত। ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের মতে, ইন্টারনেট বন্ধ করার জন্য আদালতের হস্তক্ষেপের এটাই একমাত্র নজির রয়েছে। বর্তমানে, ইন্টারনেট বন্ধের পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করে দুটি বিষয় সুপ্রিমকোর্টে বিচারাধীন। ফাউন্ডেশন ফর মিডিয়া প্রফেশনালদের দায়ের করা একটি আবেদন, এবং সফ্টওয়্যার ফ্রিডম ল সেন্টারের দায়ের করা একটি রিট পিটিশন। যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও এ বিষয়ে সরব।