গীতা দে – উপেক্ষিত এক অসামান্য প্রতিভা
এক আধ বছর বা দশক নয়, ছয় দশকেরও বেশী সময় ধরে বাংলা ছায়াছবি ও থিয়েটারে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন গীতা দে। শিশুশিল্পী হিসাবে মাত্র ছ’বছর বয়সে তাঁর অভিনয় জীবনের শুরু। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি থেকে গেছেন বিস্মৃতির আড়ালে, উপেক্ষিত এক প্রতিভা হিসেবে।
বাবা অনাদিবন্ধু মিত্র মেয়ের গান ও অভিনয়ে প্রবল ঝোঁক দেখে তাকে প্রতিবেশী গায়িকা রাধারানী দেবীর কাছে তালিম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর কাছেই গীতা দের প্রথম জীবনের নাচ, গান, অভিনয় শিক্ষা।
১৯৩৭ সালে মাত্র ছ’বছর বয়সে তিনি ‘আহুতি’ নামে একটি বাংলা ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান। ছবিটির পরিচালক ছিলেন ধীরেন গাঙ্গুলি। এরপরের ছবি ‘দম্পতি’ এবং ‘নন্দিতা’। পরিচালকরা যথাক্রমে ছিলেন নীরেন লাহিড়ী এবং সুকুমার দাশগুপ্ত।
১৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সিনেমা ও থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। ১৫ বছর বয়সে তালতলা নিবাসী ব্যবসায়ী অসীমকুমার দে’র সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের ৫ বছর বাদে তিনি আবার অভিনয় জীবনে ফিরে যান। সে সময়ে তিনি প্রখ্যাত নট ও পরিচালক শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সংস্পর্শে আসেন। ৫ বছর তিনি শিশির ভাদুড়ীর পরিচালনায় কাজ করেছেন। এই সময়ে গীতা দে নাচ ও গানে তাঁর পারদর্শিতার পরিচয় দেন।
শিশির ভাদুড়ী সম্পর্কে তিনি বলতেন— ‘শিশির ভাদুড়ী ছিলেন আমার গুরু। অভিনেত্রী হিসাবে আমার সেরা গুণাবলীকে তিনি পূর্ণ রূপ দিয়েছিলেন।’
গ্রুপ থিয়েটারে তিনি অভিনয় করেছেন বেশ কিছু বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে। যেমন তুলসী লাহিড়ী, শম্ভু মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, জ্ঞানেশ মুখার্জি, কালী সরকার, কানু ব্যানার্জি, দিলীপ রায় প্রমুখের সঙ্গে।
১৯৫৬ সাল থেকে ১৮ বছর গীতা দে ‘স্টার থিয়েটারে’ অভিনয় করেছেন। তখন সেখানে পরিচালক ছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। ১৯৭৬ সালে তিনি যোগ দেন কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে। সেখানে ‘অঘটন’ নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন জ্ঞানেশ মুখার্জির পরিচালনায়, পরে অভিনয় করেন সমরেশ বসুর ‘বিবর’ নাটকে। যেখানে পরিচালক ছিলেন রবি ঘোষ।
তাঁর অভিনীত শেষ নাটক — ‘বাদশাহী চাল’। ১৯৯৬ সালে উত্তর কলকাতার রঙ্গনা মঞ্চে এই নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন গণেশ মুখোপাধ্যায়।
১৯৫১ সালে তিনি আবার নতুন করে বাংলা সিনেমায় যোগ দেন। সে সময়ে তাঁর ছবি ছিল প্রথমে ‘শিল্পী’। পরে ‘অগ্রদূত’ পরিচালিত ছবি ‘লালু ভুলু’। তাঁর ভূমিকা ছিল এক মায়ের। এরপর অভিনয় করেন এক বোনের চরিত্রে নির্মল দে পরিচালিত ‘বিয়ের খাতা’ ছবিতে। তিনি ‘সাথীহারা’ ছবিতে অভিনয় করেন উত্তরকুমার, মালা সিনহার সঙ্গে।
১৯৫৬ ছিল তাঁর কাছে একটি যুগান্তকারী বছর। সে বছর প্রখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেন অভিনেতা কালী ব্যানার্জি। গীতা দে সেই সূত্রে অভিনয় করেন ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা (১৯৫৭), কোমল গান্ধার (১৯৫৯) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬০)।
ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে তিনি বলেছেন— ‘ক্যামেরার ব্যবহার এবং শট গ্রহণের ব্যাপারে এত বড় মাপের পরিচালক তিনি আর দেখেননি। তিনি আমার জন্য বেশ কিছু ফিল্মের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেগুলি আর বাস্তবায়িত হয়নি।’
সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’ এবং দেবকীকুমার বসুর ‘সাগর সঙ্গমে’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। ‘তিনকন্যা’ ছবির শেষ গল্প ‘সমাপ্তি’-তে তিনি ছিলেন অপর্ণা সেনের মা। তিনি বলেছেন, সত্যজিৎ রায়ে’র সঙ্গে কাজ করে তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
তিনি অভিনয় করেছেন তপন সিনহার ‘হাটেবাজারে’, ‘জতুগৃহ’, ‘এখনই’ ছবিগুলিতে।
৬০ বছরের অভিনয় জীবনে উল্লেখ করার মত তাঁর অভিনীত অজয় করের সাত পাকে বাঁধা, নৌকাডুবি, মাল্যদান, অরবিন্দ মুখার্জির নিশিপদ্ম, দুই ভাই, বর্ণচোরা, মৌচাক ইত্যাদি ছবির নাম। বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন সাবলীলভাবে। চরিত্রগুলির মধ্যে সহজে ঢুকে যেতে পারতেন বলে দর্শকরা আনন্দ পেতেন। যিনি সৃজনশীল আনন্দ দেন তাঁকে মানুষ ভোলেন না।