ষোড়শী বেনিফিট নাইট ও শিশির ভাদুড়ি, শিবরাম-শরৎচন্দ্রের এক অজানা উপাখ্যান

এহেন অকৃতদার মানুষের জীবনেও দুঃখ ছিল। হাসির আড়ালে সে দুঃখ তিনি নিয়ে গিয়েছেন, তাঁর সঙ্গেই। আসুন জেনে ফেলি সেই দুঃখের উপখ্যান। যাতে জড়িয়ে রয়েছে মঞ্চ

October 2, 2023 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: হর্ষবর্ধন আর গোবরধনের সৃষ্টাকে চেনেন তো? নিশ্চয়ই চেনেন, তিনিই আমাদের হাসির রাজা শিবরাম, শিবরাম চক্রবর্তী। বাংলাকে যিনি কলমের জোরে আজীবন হাসিয়ে গেলেন। তাঁর জীবন নিঃসঙ্গ, একাকীত্বের মেস যাপনের মধ্যেই তিনি আমাদের মুখের হাসির খোরাকটুকু জুগিয়ে গিয়েছেন আমৃত্যু। পার্থিব জীবন ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও, তাঁর সৃষ্টি আজও আমাদের ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দেয়। এহেন অকৃতদার মানুষের জীবনেও দুঃখ ছিল। হাসির আড়ালে সে দুঃখ তিনি নিয়ে গিয়েছেন, তাঁর সঙ্গেই। আসুন জেনে ফেলি সেই দুঃখের উপখ্যান। যাতে জড়িয়ে রয়েছে মঞ্চ।

শিবরামের এক অতি প্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উপন্যাস “দেনা পাওনা”-র নাট্যরূপ দেন শিবরাম‚ নাম দেন “ষোড়শী”। এই নাটক নিয়েই শিবরাম গিয়েছিলেন নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ির কাছে। শিশির ভাদুড়ি নাটকের পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন “very cleverly done”। এরপরে শিবরাম তাঁর বন্ধু জগৎ ভট্টাচার্যর কাছে নিয়ে যান এই নাটকটি, কারণ যদি জগৎ বাবু তাঁর “ভারতী” পত্রিকায় এটা ছাপেন। জগৎ বাবু রাজি। তিনি বলেন , এই নাটক তিনি ছাপাবেন কিন্তু সেটা ছাপা হবে শরৎ বাবুর নামে এবং দক্ষিণার সিংহভাগটাই শরৎ চন্দ্র পাবেন, যেহেতু উপন্যাসটা তাঁরই। শিবরাম প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন যে, ছাপা তো হচ্ছে নাটকটা, উপন্যাস নয়।

কিন্তু কী আর করবেন, অর্থাভাবে জর্জরিত শিবরাম নাটকটি ছাপাতে দিয়ে দেন, সামান্য কিছু টাকার জন্য। নাটকটি ছাপা হওয়ার পরে, থিয়েটার মহলে সাড়া ফেলে দেয় এবং শিশির ভাদুড়ি তড়িঘড়ি এই নাটকের সত্ত্ব শরৎচন্দ্রের থেকে নিয়ে আসেন। শিবরাম ভাবেন, তিনি নিজেই যখন প্রথমে এই নাটক শিশির বাবুর কাছে নিয়ে যান‚ তখন কী এর মধ্যে কোনও সম্ভাবনা দেখতে পাননি শিশির ভাদুড়ি? অভিমানে শিবরাম বিখ্যাত কথাটি বলেছিলেন, “শিশির ভাদুড়ি নহ‚ বোতলের তুমি”।
নাটক বেশ নাম করেছে, সুপারহিট বলা যায়! এরপরের এক ঘটনা, ষোড়শী-র বেনিফিট নাইট। কিছু প্রাপ্তির আশায় শিবরাম এসেছিলেন। গ্রিনরুমে শিশির ভাদুড়ি বিষণ্ন মনে বসে আছেন‚ শিবরামকে দেখে এগিয়ে আসেন একজন ছেলে। ছেলেটি বলে‚ আজকের বিক্রির সমস্ত টাকাটা একটা থলেতে করে রাখা ছিল‚ একটু আগে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এসে সেই সমস্ত টাকা নিয়ে চলে গেছেন।

শিশির কুমার ভাদুড়ি শিবরামের জন্যে দাবীর কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ফল হয়নি কিছুই, শরৎবাবু বলেছিলেন‚ শিবরামের আবার টাকার কি দরকার? মেসে থাকে‚ ঘরসংসার নেই‚ ও টাকা নিয়ে কি করবে?

শিশিরবাবু তাও বলেছিলেন‚ যদি কিছু অন্তত রাখেন শিবরামের জন্য। শরৎ চন্দ্র-এর উত্তর‚ আমার বেনিফিট নাইটের বখরা ওকে দিতে যাবো কেন? এ রাত্তিরে টিকিট বিক্রি হয়েছে আমার নামে‚ আমার জন্য টাকা দিয়ে দেখতে এসেছে সবাই। এর মধ্যে ও আসছে কোথা থেকে?
এরপরে শিশির ভাদুড়ি তাঁর নিজের থেকেই টাকা দিতে চাইলেন। শিবরামকে জিজ্ঞাসা করলে‚ একটা ক্রশচেক কেটে দেবো?

শিবরাম বলেন‚ ভাঙাবো কোথায়? আমার ব্যাঙ্কে আকাউন্ট আছে নাকি? অগত্যা শিশিরবাবু শিবরামকে একটা ১২০ টাকার পে টু সেলফ চেক কেটে দিয়ে বলেন‚ আমার সেভিংস অ্যাকাউন্টে এই টাকাটাই পড়ে আছে। শিবরাম বললেন– “আমার টাকার কি দরকার? মেসের টাকা বাকি‚ এর ওর কাছে ধার সেসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করে কি লাভ? আমার অভাবের চাকী এখানে ঘুরিয়ে কি লাভ? তা শুধু আমাকে পিষ্ট করার জন্য, অন্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভের জন্য নয়। তবে কষ্টের জায়গাটা হচ্ছে‚ কোনও ভাবমূর্তি নিছক মনগড়া হলেও তা যখন ভেঙে পড়ে তা যেন মনের খানিকটা নিয়েই পড়ে। আমার মর্মের পীঠস্থান থেকে শরৎবাবুর মর্মর মূর্তির স্খলন আমার মনে সেদিন বেশী লেগেছিল- লাভালাভের নিট হিসেবের থেকেও।”

মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা নিয়ে উপন্যাস লেখা মানবদরদী, শরৎচন্দ্র, আর বাস্তবের শরৎচন্দ্রের মধ্যে যে কোনও মিল দেখা গেল না। সাহিত্যের শরৎচন্দ্র এক নিমেষে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন, হেরে গেলেন জীবন্ত শরৎ-র কাছে, হারিয়ে দিলেন অগুনিত পাঠক পাঠিকাদের। যাঁর লেখার প্রতিটি চরনে মানুষের জন্য এত প্রেম, এত ভালোবাসা, এত ব্যাকুলতা, এত দরদ‚ বাস্তবে এতটা উলোটপুরাণ! তাহলে কি শুধুই জনপ্রিয়তা আদায়ের খোরাক…এই মানব দরদী অনুভূতি? সত্যিই কি টাকাই একমাত্র মানুষ চেনার কষ্টিপাথর? শিল্প-স্রষ্টারাও তার উর্ধ্বে নন? প্রশ্নগুলো পাঠকদের কাছেই রইল।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen