রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রা কলঙ্কিত করেছিল বাঙালি
বাইশে শ্রাবণ, তেরোশো আটচল্লিশ বঙ্গাব্দ বাঙালির ইতিহাসে এক দুঃখের দিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়ানের এই দিনটা আরও কলঙ্কময় হয়ে উঠেছিল কবির শেষযাত্রায় কিছু বিতর্কিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঠিক কি ঘটেছিল সেদিন? রবি ঠাকুরের শেষযাত্রায় জনজোয়ারের বাঁধ ভেঙেছিল। সেদিনের সঙ্গে তুলনীয় হয়তো কেবল চিত্তরঞ্জনের, উত্তমকুমারের, সত্যজিত্ রায়ের শেষযাত্রা। কিন্তু অন্য কারও শেষযাত্রা এতটা বিতর্কিত হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথকে মৃত্যুর পরে যে অপমান সৈতে হয়েছে তা সত্যি ইতিহাসে বিরল।
কবিকে নিয়ে জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতনের একটা টানাপোড়েন অনেকদিন ধরেই চালু ছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী এই জিনিয়াস যে আসলে তাঁদেরই ‘নিজস্ব’ জন, এটা প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিল দু’পক্ষই। কবির শেষ বয়সে এই দ্বন্দ্ব তিক্ত আকারনেয়, মৃত্যুলগ্নে এসে তা রীতিমতো লড়াইয়ে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে ঝুঁকে ছিলেন শান্তিনিকেতনের দিকে। আশ্রমেই ছিল তাঁর প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। কিন্তু, ভাগ্যের পরিহাস, শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করলেন তিনি কলকাতাতেই।
রবীন্দ্র-ঘনিষ্ঠ অনেকেই সে শেষ মুহূর্তের ও শেষ দিনটির নানা ধরণের বিবরণ রেখে গেছেন। বুদ্ধদেব বসু তো উপন্যাসেও অমর করে রেখেছেন সেই দিনের কেলেঙ্কারি। বিশিষ্টজনের উঠে এসেছে ন্যক্কারজনক ঘটনাবলির বয়ান। ‘রবীন্দ্রনাথ কি জয়’ চিত্কারে মত্ত উচ্ছৃঙ্খল ভিড় লোহার গেট ভেঙে উঠে এসেছিল দোতলার বারান্দায়, তাঁর শেষ শয্যার অনতিদূরে। কবির মৃতদেহ স্নান করানোর নিভৃত মুহূর্তটি হয়েছিল কালিমালিপ্ত।
এছাড়াও, শান্তিনিকেতনের ছাপ মিলছে এমন লোকজনকে বেছে বেছে অপমান করছিল ভিড়ের মধ্যে একদল লোক। সবচেয়ে বহুল প্রচারিত যে কলঙ্ক – ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী সহ একাধিক ব্যক্তি যার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবী করেছেন – তা হল, কবির মৃতদেহ থেকে চুল ও দাড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার ঘটনা। শবের পাশে বসে নন্দলাল বসু নাকি পাখার বাঁট দিয়ে সেই ‘স্মারক’-লুব্ধ ভক্তদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, বিবরণে এমনও আছে।
অভিযোগের পরবর্তী স্তরে উঠে আসে শবযাত্রার চূড়ান্ত অব্যবস্থার কথা। প্রিয় কবিকে দূরদূরান্ত থেকে অনুরাগীরা দেখতে আসছিলেন, তার আগেই অস্বাভাবিক দ্রুততায় একদল ‘অভিসন্ধিপরায়ণ’ লোক পুরো প্রক্রিয়াটিকে কব্জা করে ঝড়ের গতিতে দেহ নিমতলা শ্মশানে নিয়ে চলে যায়। বহু ভক্ত সেই শোকমিছিলের অবিশ্বাস্য বেগের কাছে পরাস্ত হন, তাঁদের ফুল মালা হাতেই রয়ে যায়। শ্মশানের ছবিটি ছিল আরও ভয়াবহ। এমন একজন অসামান্য ব্যক্তির দেহ কীভাবে সম্মানজনক ভাবে সত্কার করতে হয়, শ্মশান বা কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কেউই তার জন্য প্রস্তুতি রাখেননি। একটা বেড়া পর্যন্ত ছিল না মৃতদেহের সুরক্ষার জন্য। চিতা নির্বাপনের সময় অর্ধদগ্ধ অস্থি সংগ্রহের জন্য জনতা পাগল হয়ে উঠেছিল বলেও উল্লেখ করেছেন অনেকে।
যে কথাটি অনেকেই শুনলে চমকে ওঠেন আজও তা হল, ছেলের হাতের আগুন পাননি রবীন্দ্রনাথ! ভিড়ের চাপে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্মশানে পৌঁছতেই পারেননি। শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ। তাছাড়া, কবি নিজে ব্রাহ্ম রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য চেয়ে এসেছিলেন বরাবর। কিন্তু সে ইচ্ছার মর্যাদা রাখা হয়নি।
যার লেখনির জোরে বাঙালির জাতিসত্ত্বা আজও জোজুল্যমান, সেই গুরুদেবের শেষযাত্রা এক কলঙ্কিত অধ্যায়ে রূপান্তরিত করেছিল বাঙালি।