বাংলা, বাঙালি এবং কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর স্ত্রী-আচার
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়। আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আরও একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পুজা বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস কল্পনার সৃষ্টি, শস্য – প্রাচুর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা ঘট লক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কত ঘটের পূজা।’ এসবই এসেছে ওপার বাংলা থেকে, অধুনা আমরা কলা গাছে, কোথাও মাটির সরায়, পটে ধানের ছড়ায় দেবীকে কল্পনা করে পুজো করেন। কদম ফুলেও দেবীর আরাধনা করা হয়। কোথাও আবার থোড়ের তৈরি নৌকোতেও পুজো করা হয়।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ব্রতকথায় লিখছেন দেবীপক্ষ শেষের পূর্ণিমাটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। ভক্তের বিশ্বাস ওইদিন কে জেগে আছেন? তা দেখতে দেবী আসেন। আশ্বিন পূর্ণিমায় যখন হৈমন্তিক শস্য ঘরে আসে, তখন এই ব্রত পালিত হয়। সন্ধ্যায় আয়োজিত এই পুজোয় সকাল থেকে আলপনায় সেজে ওঠে বাড়ি, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, লক্ষ্মীপেঁচা এবং ধানছড়া আঁকা হয়। এছাড়াও পদ্ম, ধানছড়া, কলমিলতা, দোপাটিলতা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকা হয়। বেড়ের মধ্যে একটি পূর্ণ ভাঁড় রাখা হয়। শুয়োরের দাঁত ও সিঁদুরের কৌটা রেখে তার উপরে নানারকম ফল ইত্যাদি সাজানো হয়। রচন পাত্রের গায়ে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন ও ধানছড়া আঁকা হয় এবং তার উপরে লক্ষ্মীর সরা থাকে। তাতে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কালো রঙ ব্যবহার করে লক্ষ্মী নারায়ণ, লক্ষ্মীপেঁচার আলপনায় রাঙানো হয়।
লক্ষ্মী সরার উপরে আধখানা নারিকেলের মালা রাখা হয়, মেয়েরা এই মালাকে কুবেরের মাথা বা মাথার খুলি বলে। ওপার বাংলার যশোর অঞ্চলে একটি নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। সরার উপর একটি শীষ সমেত ডাব রাখা হয়। তাতে ঘোমটা দিয়ে, গহনা পরিয়ে সাজানো হয়। কলার খোল দিয়ে বের বানানো হয়, ধানের গোলার মতো কতগুলি ডোলা রাখা হয়। সেখানে নানাবিধ শস্য রাখা হয় যেমন ধান, তিল, মুগ, মুসুরি, মটর ইত্যাদি। লক্ষ্মী সাথে নারায়ণও পুজো পান। শস্যের দেবী হওয়ার কারণে লক্ষ্মীকে ধরিত্রী বা বসুমতী হিসেবে গণ্য করা হয়। বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী, বরাহরূপী বিষ্ণু ধরিত্রী বা বসুমতীকে পত্নী রূপে গ্রহণ করছেন। অর্থাৎ, শস্যদায়িনী লক্ষ্মী এবং শস্যদেবী লক্ষ্মী উভয়ই এক এবং অদ্বিতীয়।
কোজাগরী পুজোর পদ্ধতিতে এপার বাংলায় এবং ওপার বাংলায় ফারাক দেখা যায়। পুজো উপচার ও নৈবেদ্য-ভোগেও থাকে পার্থক্য। এ বঙ্গের লক্ষ্মীপুজোয় সাধারণত ফলমূল, মিষ্টি আর বড়জোর লুচি ভোগ নিবেদন করা হয় কিন্তু ও বঙ্গের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে অন্নভোগ বা কোথাও কোথাও ইলিশমাছের পদও দেবীকে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়ে থাকে। বাঙাল পরিবারগুলিতে অর্থাৎ পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে মা লক্ষ্মীকে আমিষ ভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে। লাবড়া, খিচুড়ি তো থাকেই, তার সঙ্গে দেওয়া হয় ইলিশ মাছ। বহু বাঙাল বাড়িতে মা লক্ষ্মীকে জোড়া ইলিশ ভোগ দেওয়া হয়৷ ভোগের ইলিশ মাছ রান্না করা হয় আলু, বেগুন বা কুমড়ো দিয়ে৷ সঙ্গে দেওয়া হয় এক খিলি পান।
পূর্ববঙ্গীয় বহু পরিবারে লক্ষ্মী পুজোর দিন মাছের পাঁচ রকম পদও রান্না করা হয়৷ ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল এলাকার মানুষদের মধ্যে দেবীকে আমিষ ভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে।
মাটির মূর্তি গড়ে, বা পূর্ণকলসে আমের পাতা দিয়ে তার ওপর কলসের মুখে বংশবৃদ্ধিমূলক উর্বরতা বিশ্বাসের প্রতীক ডাব বসিয়ে রেখে দেবীর পুজো করা হয়। অব্রাহ্মণ গৃহে লক্ষ্মীপট বসিয়ে পুজো করার রেওয়াজ রয়েছে। লক্ষ্মীপটে লক্ষ্মীর মূর্তি আঁকা থাকে। বঙ্গেই লক্ষ্মীপটের জন্ম। পাঁচালি, বাংলার লোকরচনা থেকে, পুজো মন্ত্রের জন্ম। লক্ষ্মীপট পুজোর অঙ্গ হল আনুষঙ্গিক অলঙ্করণ, অর্থাৎ আলপনা। চালের গুঁড়ো জলে গুলে আলপনা আঁকা হয়। পুজোর জায়গার চারদিকে এবং পুজোস্থলে যাওয়ার পথে আলপনা আঁকা হয়।