সোনামুখী কালীর সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেল বর্গীরা?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে’ – বহুশ্রুতি এবং বহুলপ্রচলিত এই ঘুমপাড়ানি ছড়া বা ছেলে ভোলানো ছড়ার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সুবে বাংলায় বর্গী আক্রমণের ইতিহাস।
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?
ধান ফুরলো, পান ফুরলো, খাজনার উপায় কি?
আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।
ফার্সি শব্দের মারাঠী অপভ্রংশ বার্গী থেকেই বর্গী শব্দের জন্ম। মরাঠারাজ রঘুজি ভোঁসলের নেতৃত্বে ১৭৪১ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৭৫১-র মে মাস পর্যন্ত মরাঠা বর্গীরা ছ-বার বাংলায় আক্রমণ চালিয়েছে। বাংলায় তখন আলীবর্দীর শাসন চলছে। মরাঠা ঘোড়সওয়ার বর্গীরা ছিল লুঠতরাজপ্রবণ, দুঃশ্চরিত্র, কিন্তু তারা ছিল বীর পরাক্রমী যোদ্ধা। এই সময়ে বর্গী আক্রমণের ফলে বাংলা ও বিহারের প্রায় চার লক্ষ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল এবং বাংলার প্রভূত ধন-সম্পত্তি লুঠ হয়েছিল।
মহিলাদের উপরেও শারীরিক নির্যাতন চালাত বর্গীরা, শিশু-বৃদ্ধরাও রেহাই পেত না। বর্গীনেতা ভাস্কর পন্ডিতকে হত্যা করেও নবাব, বর্গী আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হন। অবশেষে বাংলার নবাবের সঙ্গে চৌথ আদায়ের (অর্থাৎ নবাবকে দেওয়া রাজস্বের একচতুর্থাংশ, যার পরিমাণ ছিল বার্ষিক বারো লক্ষ টাকা) চুক্তিতে সন্ধি হলে কিছু দিনের জন্য আক্রমণ বন্ধ হয়েছিল। এই ছড়ার মধ্যে খাজনা আদায় সংক্রান্ত উদ্বেগও স্পষ্ট, যদিও পূর্ববঙ্গে বর্গী আক্রমণ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চল অবধি এই আক্রমণ চালাত বর্গীরা। মুর্শিদাবাদে বর্গীদের প্রতিষ্ঠা করা শিব মন্দির আজও দেখা যায়।
এই সময় বর্গীদের ভয়ে বহু মানুষ কলকাতা ও পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান। কলকাতায় মারাঠা খাতও খনন করা হয়েছিল বর্গী আক্রমণ ঠেকাতে। কেবল মুর্শিদাবাদ নয়, বাঁকুড়া ও অবিভক্ত মেদিনীপুরও বিধ্বস্ত ছিল বর্গী আক্রমণের ফলে। বাঁকুড়ার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী জনপদ হল সোনামুখী। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হল দুর্গাপুজো, কিন্তু এই সোনামুখীর শ্রেষ্ঠ উৎসব হল দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালী আরাধনা। তাই কথায় বলে, ‘কালী কার্তিকে সোনামুখী’। একশোরও বেশি কালীপুজো হয় এই সোনামুখীতে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘মা-ই-তো কালী’। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো এই কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার বর্গী আক্রমণের ইতিহাস।
জনশ্রুতি রয়েছে, একবার বর্গী আক্রমণের হাত থেকে সোনামুখীকে রক্ষা করেছিলেন স্বয়ং এই ‘মা-ই-তো কালী’। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ, মরাঠা বর্গী সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের আক্রমণে গোটা বাংলা তখন ভীত সন্ত্রস্ত। তৎকালীন বিষ্ণুপুরে মল্ল রাজাদের মল্ল সৈন্যবাহিনীর কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয় বর্গীরা। বিষ্ণুপুরে লুঠপাটের পরিকল্পনা বাতিল করে, বর্গীরা সোনামুখীর অভিমুখে অগ্রসর হয়।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, কোনও এক সন্ধ্যায় সোনামুখী শহরের রানির বাজারে হাজির হয়েছিল বর্গী বাহিনী। সেই সময় বর্গীরা দেখতে পায়, চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা একটি ছোট্ট মন্দির, তার ভিতরে প্রদীপ জ্বলছে। হাঁড়িকাঠের সামনে মাথানত করে মাকে প্রণাম করছেন এক বৃদ্ধ পুরোহিত। কথিত আছে, হাতের খড়গ দিয়ে ওই পুরোহিতকে বলি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন বর্গী সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত। সেই সময় মায়ের কৃপায় তার হাতের খাড়াটি আটকে যায়। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন ভাস্কর। বাকি বর্গী সেনাদের বিষয়টি বুঝতে একটুও দেরি হয়নি, সেনাপতির দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা প্রার্থনা করতে শুরু করেন। সেই প্রার্থনায় দেবীর কৃপা লাভ করেন ভাস্কর পণ্ডিত, এবং শেষ পর্যন্ত তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। এরপরেই মরাঠা সেনারা একত্রে চিৎকার করে বলে ওঠেন ‘মা-ই তো মা, কালী হ্যায়’। সেদিন সাক্ষাত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল সোনামুখী, সোনামুখীকে বাঁচিয়ে দিলে মা।
আজও এই সোনামুখীতে ‘মা-ই-তো কালী’ মায়ের পুজো হয়ে আসছে। পুজোর পর দেবী মূর্তির বিসর্জন হয়, কিন্তু ঘট বিসর্জন হয় না। পরের বছর কালীপুজোর দিন পুরনো ঘট বিসর্জন দিয়ে, আবার নতুন ঘট স্থাপন করা হয়।
আজও দেবীর বিসর্জনের সময় কোচডিহি গ্রামের ৪২ জন বেহারা মন্দির থেকে কাঁধে করে দেবীমূর্তি নিয়ে গোটা সোনামুখী শহর প্রদক্ষিণ করেন। পরে স্থানীয় একটি পুকুরে বিসর্জন করা হয় দেবীমূর্তি। ঠিক আগের মতো, ঐতিহ্য মেনেই এটি হয়ে আসছে। এবারও কার্তিক অমাবস্যায় পূজিতা হবেন দেবী।