কালোমানিক থেকে মানিক, কীভাবে লেখার জগতে এলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র স্রষ্টা?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ১৯৩৩ সাল, কলকাতায় এক বিখ্যাত পুতুল নাচের দল এল। সেই দলের নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়লেন, আজকের ভাষায় ফিদা হয়ে গেলেন এক লেখক। পুতুল আর মানব জীবনকে উপজীব্য করেই লিখে ফেললেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। আর নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি বাংলা সাহিত্যের এক ব্যানার্জী। মানিক ব্যানার্জী। প্রথম থেকেই কিন্তু তাঁর ওই নাম ছিল না।
চার ভাইবোনের পরে ব্যানার্জীবাড়িতে এক কালো ছেলে জন্মাল, গায়ের রং দেখেই আঁতুড়ঘরে তাঁর নাম দিয়ে দেওয়া হয়েছিল কালোমানিক। আবার বর্ণ বিদ্বেষ ভেবে নিলে মুশকিল হবে! বাড়িতে যেমন আদুরে নাম রাখা হয়, তেমনই হল। পটলা, ঘোতন জাতীয় আর কি। আমার দাদুর এক বন্ধু ছিল, তাঁর নাম ছিল কালো, শুধুই কালো। ভারী অদ্ভুত! কী ভেবে এমন ডাকনাম রেখেছিলেন বাবা-মা, কে জানে!
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম তো তাও কালোমানিক। ভালবেসে কালোমানিক বলেই ডাকত সকলে। তারপর যা হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে, কালে কালে কালোমানিক থেকে কালো অবলুপ্ত হয়ে, পড়ে রইল শুধুই মানিক। ব্রাহ্মণবাড়ির ছেলে, তাই প্রথা মতো ঠিকুজিকুষ্টি তৈরি করা হল। ঠিকুজিতে নাম রাখা হল অধরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও সেই নামে কেউই কোনদিন তাঁকে ডাকেনি। বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় সাধ করে ছেলের নাম রাখলেন প্রবোধকুমার। সেই নামও আড়ালে রয়ে গেল।
স্নাতকস্তরে গণিত নিয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন মানিক। একদিন কলেজ ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল তর্ক শুরু হল। এক বন্ধুর লেখা গল্প কোন এক নামজাদা পত্রিকা থেকে বাদ পড়েছে। মনোনীত না হয়েই ফিরে এসেছে। সেই বন্ধু রেগে-মেগে বললে, বড় পত্রিকাগুলি বিখ্যাত লেখকদের লেখা ছাড়া ছাপায় না। যা হয় আরকি! আমরা ফেলিয়ারকে ঢাকতে অজুহাত খুঁজি; ছেলেটিও তাই করেছিল। কিন্তু বাধ সাধলেন একজন, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন। বললেন, ‘এটা হতেই পারে না। তুমি ভুল বলছ। তোমার গল্প ভাল হয়নি বলেই তারা ছাপেনি। পছন্দ হলে নিশ্চয়ই ছাপত।’ বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী লোক ছিলেন তো, পদে পদে প্রতিবাদ।
বন্ধুও ছাড়বার পাত্র নয়, পাল্টা দিলেন, প্রমাণ করে দেখাতে পারবে বলে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন। চ্যালেঞ্জটা নিলেন মানিক। বললেন তিনমাসের মধ্যে নামকরা কোন পত্রিকায় গল্প ছাপিয়ে দেখিয়ে দেবেন। তিন মাস নয়, তিনদিনের মধ্যে একটা গল্প লিখে ফেললেন। গল্পকারের নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখতে গিয়েও লিখলেন না, থমকালেন।
জীবনের প্রথম গল্প। সম্পাদকের পছন্দ হবেই সে বিষয়ে তিনি প্রত্যয়ী। ‘অতসী মামী’ আদপে ছিল অবাস্তব রোম্যান্টিকতায় ভরা এক গপ্পো। তাই ওই নাম ‘নেহি চালেগা’। প্রবোধকে সরাতেই হবে, কতকটা সংকোচ থেকেই প্রবোধকুমারের বদলে লেখকের নাম লিখলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর সেই গল্প নিয়ে নিজেই সটান হাজির ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার দপ্তরে। সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ সেই সময় দপ্তরে ছিলেন না। তার জায়গায় বসেছিলেন সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। অচিন্ত্যকুমারের স্মৃতি কথায় এই দিনটি উঠে এসেছে। তাঁর কথানুযায়ী, গল্পটা ছিল দুর্দান্ত, তিনি পড়তে পড়তে বিস্মিত হয়েছিলেন।
সেই গল্প ছাপা হল! বাংলা সাহিত্য নতুন এক ব্যানার্জী পেল, পেল এক খাঁটি মানিক! আর বাংলার পাঠকমহলে হইহই রব উঠে গেল। বিচিত্রার সম্পাদক খোঁজখবর নিয়ে ছুটে এলেন মানিকের সঙ্গে দেখা করতে। লেখার সাম্মানিক কুড়িটা টাকা হাতে দিয়ে গল্প নেওয়া পাকাপাকি করে ফেললেন। বাজি রেখে গল্প লিখেই কিস্তিমাত করে দিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।