দেশভাগের স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে আতঙ্কের এনআরসি
দেশভাগের সময় মানুষ ‘দ্যাশ হীন” হয়েছিল। ছিন্নমূল মানুষের হাহাকারের সাক্ষী ছিল ইতিহাস। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি-আতঙ্ক সেই ঘটনার কথাই মনে করিয়ে দেয়। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা এসেছিল ২০০ বছরের সামাজ্যবাদী শাসনের অবসানে। সেই মুক্তি ‘দেশ’-এর সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিল।
যেখানে বড় হয়ে ওঠা, পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটা, খুব সহজেই চেনা যায় মাটির ঘ্রান, যেখানে অন্ধের মতো চোখ বুজেও রাস্তা চেনা যায়, সেটা আমার দেশ না! এই প্রশ্নটাই সেদিন জেগেছিল সবার মনে। অনেকেই হিন্দুর দেশ, মুসলমানের দেশের সংজ্ঞাটা বোঝেননি। অনেকেই দেশভাগ চাননি। যুক্তবঙ্গ চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশকে ভালোবাসাটাই “নাগরিকত্বের” মাপকাঠি নয়, বুঝিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্র।
দেশভাগের সময় হওয়া, দাঙ্গা, ধর্ষণ, হৃদয়বিদারক বিবরণের সাক্ষী প্রতিটি ইতিহাস বই। সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি এনআরসি বা এনপিআর-এ। মৃত্যুর আতঙ্ক বোধহয় এতটা গ্রাস করে না মানুষকে, যতটা গিলে নিয়েছে ভোটার তালিকায় ভুল নাম থাকার সন্দেহ কিংবা ডিজিটাল রেশন কার্ডের উদ্বেগ।
যারা কয়েকদিন আগেও ধর্ম-বিদ্বেষ ছড়াত, তারা সব ভুলে নাম সংশোধনের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছে, যেমনটা দেখা গিয়েছে নোটবন্দির সময়। যেমনটা দেখা গিয়েছিল একাত্তরের শরণার্থীদের হাহাকার মিছিলের সময়। স্থান-কাল-পাত্র বদলিয়ে দিলে বোধহয় একে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না।
এই কিছুদিন আগেও এক শ্রেণির মানুষ রোহিঙ্গাদের নিয়ে তিতিবিরক্ত হত। আজ যদি সারা দেশে এনআরসি হয়, তাহলে ভারত কি আরেকটি মায়ানমার বা সিরিয়া হয়ে উঠবে না! বঙ্গোপসাগরের তীরে কোনও নিশ্চল আয়লান কুর্দি পড়ে থাকবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
স্পষ্ট অনুমান করা যায়, এনআরসি একটি বড়সড় খেলা। যে খেলার মুল উদ্দেশ্য হল, নাগরিক হিসেবে মুসলিমদের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। তবে এর কাউন্টার ন্যারেটিভও রয়েছে। অসমে মুসলিম তাড়াতে গিয়ে বেশিরভাগ হিন্দু বাদ চলে গেল চুড়ান্ত তালিকা থেকে। আত্মহত্যা করলেন বেশ কিছু মানুষ, দুই ধর্মেরই।
এজন্যই এনআরসি এখন আতঙ্কের অপর নাম। এনআরসি ইটভাটার শ্রমিককে আত্মহত্যাতে উসকানি দেয়। উত্তরবঙ্গের হিন্দু পরিবারের সদস্যকে আতঙ্কিত করে। ভাবিয়ে তোলে, আমার জমির পুরনো দলিল-পরচা খুঁজে পাচ্ছি না, আমি কি এনআরসিতে থাকব? দুশ্চিন্তা একসময় তাঁকে নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে।
এই মৃত্যুদূতের নামই এনআরসি। যার জমি নেই, কিংবা যে পাগল কোন গাঁয়ের তা কেউ জানে না, তার নাগরিকত্ব কীভাবে ঠিক করবে এই এনআরসি!
এখনও বাংলায় এনআরসি প্রক্রিয়া আরম্ভ হবে এমন কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি হয়নি। তবে রাজ্যের একশ্রেণির রাজনীতিবিদ তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে বার বার এনআরসি নিয়ে হুমকি দিচ্ছেন। রাজ্য থেকে দু-কোটি মানুষকে এনআরসি করে তাড়াবেন, এমন হুমকিও শোনা গেছে। স্বভাবতই এর ফলে বাংলাজুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
রাজ্যের খেটে-খাওয়া মানুষ, দরিদ্র মানুষ, নিরক্ষর মানুষ এই ধরনের হুশিয়ারিতে ভয় পেয়েছে। রাজ্যে এনআরসি করতে হলে রাজ্যের অনুমতি নিতে হবে, আদালতের নির্দেশ লাগবে। অথচ, নিছক গুজবের কারণে আজ বাংলার মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এক শ্রেণির অসচেতন, দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ কিছু পোস্ট শেয়ার করে আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন। এর ফল ভোগ করছে গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষই!
দেশভাগের সময় শ্যামাপ্রসাদ, জিন্না, প্যাটেলরা যেমন ‘যেন তেন প্রকারেণ’ ক্ষমতা দখলকেই মনজিল বানিয়েছিলেন, তেমনি এই পরিস্থিতিতেও কুরসি বাঁচাতেই ব্যস্ত রাজনৈতিক নেতারা। তাঁদের এক-একটি বাক্য যে কীভাবে সাধারণ নাগরিকদের মনে আতঙ্কের চোরাস্রোত বইয়ে দিচ্ছে, তার খোঁজ তাঁরা রাখছেন না। তাহলে দেশভাগের কী সুফল মিলল?
এ্রনআরসি তো সেই দৃশ্যের কথাই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে। যে দেশভাগ আমাদের জন্মের আগেই হয়ে গেছে, সেই লাইন যেন আরেকবার দেখতে হবে। যে লাইন এ্রকসময় এপার ও ওপারের সীমান্তজুড়ে ছিল, যে লাইন ছিল দণ্ডকারণ্যের দিকে, আন্দামানের দিকে। আর নয়া ‘দেশহারা’দের লাইন তো অন্ধকারের দিকে।
যে দেশে নেতা-মন্ত্রীরা ডিগ্রির সার্টিফিকেট দেখাতে পারেন না, সে দেশের মানুষ কী করে পূর্বপুরুষের দলিল খুঁজে বের করবে? কোন উত্তর নেই!