কনকনে শীত, মাঘের বারিষ – কেমন হল বইমেলার শুরুয়াৎ?
সৌভিক রাজ
বারবার মনে হয়, জাতির একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত ভাষা। জাতের সে সংজ্ঞাকে মাথা রেখে বলি, বইয়ের মেলার জন্য অপেক্ষা করা একমাত্র বাঙালি জাতির পক্ষেই সম্ভব। ই-বুক, ফাইভ জি-ফি-কে just পাত্তা না দিয়ে, দিব্য ছাপা বইয়ে মজে রয়েছে জাতটা! দুগ্গাপুজোর ষষ্ঠীর আগের দিনের মতো ব্যস্ততা চলছিল। অপেক্ষার প্রহর শেষে, ১৮ তারিখ (জানুয়ারি) অর্থাৎ গতকাল থেকে শুরু হল মেলা। এবার বেশ বহুদিন পর কনকনে ঠান্ডায় মেলা। শেষ ক’বার মনে আছে বইমেলার সময় হালকা করে ফ্যান চালাতে হত।
মেঘে ঢাকা পড়ন্ত বিকেলে যখন বাইক থেকে নামছি মেলার গেটে, তখন উদ্বোধনের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। মাইকে শুনছি। ওদিকে হাতুড়ির ঠুক-ঠাক, কেউ পেরেক ঠুকছে। কেউ ফ্লেক্স লাগাচ্ছে। কোনও কোনও স্টল সেজে উঠেছে। কেউ কেউ সাজাচ্ছে, কোনও প্রকাশক আবার কী মাপের ফ্লেক্স করা যায়, তা নিয়ে ভাবছে। আবার কোনও স্টলে এখনও পা পড়েনি আগামী ক’দিনের মালিকের। লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়নও পুরোপুরি সেজে ওঠেনি আজ। ভাগ্যিস বইমেলায় কোনও শ্রীভূমি নেই!
আপাত বড় বড় স্টলগুলোতে বই সাজানো সারা। তখনও মেলায় বই কারবারিদের ভিড়। পুলিশের সংখ্যাও বেশ। খাবারের স্টলগুলোও ঠিক করে গোছানো হয়নি। চাওয়ালাদের দেখা নেই। তবে এবার বেশ কিছু ঘটিগরমওয়ালার দেখা মিলল। ঘটি আছে কিন্তু Hot নয়। দেখি ক’জন রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে জিগ্যেস করছে ঠান্ডা চানাচুর!? করুন মুখে ঘটিগরমওয়ালার জবাব নিয়ম নেই যে। আমি আর আমার এক প্রকাশক বন্ধু কিনলুম কুড়ি টাকার। তখন আর ফোঁটা ফোঁটা নয়, বেশ জোরেই বৃষ্টি হচ্ছে। মাছি মারার দশা। ঘটিগরমে আমড়া বেশি নাকি চানাচুর তাই গুনছি। দু-চারটে করে বই বিক্রি হচ্ছে।
এরই মধ্যে এক বন্ধু প্রকাশক ডাকল। সে বেচারার সকাল থেকে খাওয়া জোটেনি, খেতে যাবে স্টলটা একটু দেখতে হবে। পেটিম স্ক্যানার আর বিল-বই নিয়ে বসলাম। ক্রেতারা এলো, হাজার প্রশ্ন করল। বইও কিনলো। গতকাল বেশিরভাগ ক্রেতাই ছিল অল্প বয়সী, যাঁরা মেলায় ঘুরছেন তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই জেন-ওয়াই। প্রেমিক-প্রেমিকা বেশি, নিব্বা-নিব্বি গোছের নয় কিন্তু। কিছু বন্ধুবান্ধবদের গ্ৰুপও আছে। ফ্রেন্ডজোনের ওজন এখন বিস্তর। কেউ কেউ পরিবার নিয়ে এসেছে। কলেজ পড়ুয়া, স্কুল পড়ুয়া, অফিস ফেরত যুব-যুবতী। পেপারব্যাক পছন্দ হতেই নিল না, হার্ড কভার কপি চাই- এমন ক্রেতাও দেখলাম।
তারপর জাঁকিয়ে বৃষ্টি নামল, এক প্রকাশক গান ধরল ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে…!’ বই বিক্রেতাদের মাথায় হাত, কয়েকজনের স্টল ভিজে গিয়েছে, বই ভিজে গিয়েছে। গিল্ড থেকে মাইকে ডেকোরেটরদের বারবার ডাকছে, সে ঘোষণা কানে আসছে। প্রকাশক, বিক্রেতাদের বরাভয় দিয়ে বলছে, ডেকোরেটরদের লোক যাবে চিন্তা করবেন না। ছাড় নিয়ে যতই ছড়াক, গিল্ড-ই মেলাকে এই অবধি নিয়ে এসেছে। পিকে ব্যানার্জির ভোকাল টনিকের মতো ওরা মাঠের রাশ হাতে রাখতে ব্যস্ত। বৃষ্টিকে ভিলেন হতে দেওয়া যাবে না। কারণ সব জায়গায় ডাকওয়ার্থ-লুইস চলে না। সেই গোটা ত্রিশেক স্টল থেকে আজকের হাজার স্টলের মেলা! গিল্ডকে ম্যাচ অফ দ্য সিরিজ বলতেই হয়। পাঠক, লেখক, প্রকাশক, ক্রেতা, বিক্রেতা সব্বাই মিলে তৈরি টিমকে ওরা জিতাবেনই। এ তো গেল মেলার কথা।
মেলার বাইরে কেমন?
মেলার বাইরেও আরেক মেলা। মেলা লোকের মেলা। মেলার বাইরে চাওয়ালাদের বেশ পসার জমেছে ঠান্ডা পড়ায়। লোকজন খাচ্ছে। থুড়ি পান করছে। কয়েক পিস চপের দোকানের দেখা পেলাম, ধনে পাতার বড়া ফ্রাই হচ্ছিল সে’সময়। মেলার বাইরে সাত নম্বর গেটের দিকে এক মহিলা গয়না বড়ি নিয়ে বসেছে। প্যাকেট সত্তর টাকা, রোজ থাকবেন বললেন। মেলা থেকে বেরোতে বেরোতে বেশ রাতই হল। ফুটপাতের ইংরেজি বইয়ের দোকানগুলো বই তুলে ততক্ষণে ত্রিপল গোটাচ্ছে। মেট্রোয় তখনও বেশ ভিড়। শিয়ালদার লোকাল ট্রেনগুলোতেও ভিড়। দু-চারজন ডেলি প্যাসেঞ্জার নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, আজ থেকে শুরু হল ভিড়। এবার মেলার ভিড়টা পড়বে। সব মিলিয়ে শুরু হয়ে গেল বইয়ের মরশুম।