বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

সত্যিই কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক? 

August 24, 2020 | 2 min read

কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক – এই কথাটির সঙ্গেই আম বাঙালি পরিচিত। অনেকে এও জানেন, ২৪শে আগস্ট ১৬৯০ সালে চার্নক কলকাতায় পদার্পণ করেন, সেই হিসেবে ২৪শে আগস্টই হল কলকাতার জন্মদিন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? চার্নক কি আদৌ কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা?

এই কথা প্রথম উড়িয়ে দেন রাধারমণ মিত্র। ১৯৯১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘কলকাতা বিচিত্রা’। সে-বইয়ে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন, ২৪শে আগস্ট ১৬৯০ তারিখটি কলকাতার জন্মদিন নয়, আর জোব চার্নকও কলকাতার জন্মদাতা নন। এই যুক্তির সপক্ষে তিনি বিভিন্ন উদাহরণও দেন –

• ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত মনসাবিজয় কাব্যে ‘কলিকাতা’র উল্লেখ আছে – ‘পূর্ব কূল বাহিয়া এড়ায় কলিকাতা/বেতোড়ে চাপায় ডিঙ্গা চাঁদো মহারথা।’ অনেকে বিপ্রদাসের লেখায় ‘কলিকাতা’ শব্দটি প্রক্ষিপ্ত অর্থাৎ পরে সংযোজিত, এমন বলেছেন। রাধারমণের যুক্তি, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কোনোকিছুকেই প্রক্ষিপ্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া অন্যায়।

• ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও রয়েছে কলকাতার উল্লেখ – ‘কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা/বেতোরেতে উত্তরিল অবসান বেলা।’ এটিকেও অনেকে প্রক্ষিপ্ত বলে দেগে দিয়েছেন।

• ১৬৭৬-৭৭ সালে কৃষ্ণরাম দাস রচিত কালিকামঙ্গল কাব্যে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় কলকাতার – ‘অতি পুণ্যময় ধাম/সরকার সপ্তগ্রাম/কলিকাতা পরগণা তায়।’

এছাড়াও আরও কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে রাধারমণ বুঝিয়ে দিয়েছেন, জোব চার্নক আসার আগেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। চার্নক এলেন এবং কলকাতার প্রতিষ্ঠা করলেন – এমন ভাবা ভুল।

রাধারমণ দেখালেন, ইংরাজদের নথিপত্রে ‘ক্যালকাটা’ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৮৮ সালের ২২শে জুন চার্লস আয়ার ও রজার ব্র্যাডিলের লেখা একটি চিঠিতে। এরপরেও, ১৬৯০-এর আগে একাধিক চিঠি ও রিপোর্টে এসেছে ‘ক্যালকাটা’ শব্দটি। আর, ২৪শে আগস্ট ১৬৯০ তারিখে জোব চার্নক যে প্রথম কলকাতায় এলেন, তাও নয়। এটি তাঁর তৃতীয় আগমন। এর আগেও দু-বার কলকাতায় এসেছিলেন তিনি।

২০০১ সালের ১লা আগস্ট সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদ কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থবিরোধী একটি মামলা দাখিল করে। সেই মামলায় বাদী পক্ষে ছিলেন রাধারমণ মিত্র-সহ ন’জন নাগরিক এবং সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদের তিনজন। প্রতিবাদী পক্ষে – ১। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, ২। কলকাতা পুরসভা, ৩। কলকাতা পুরসভার মহানাগরিক, ৪। কলকাতা পুরসভার কমিশনার, ৫। পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষাবিভাগের সচিব এবং ৬। ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারবিভাগের সচিব। বাদীপক্ষের হয়ে সওয়াল করেছিলেন স্মরজিৎ রায়চৌধুরী ও অজিত পাঁজা। প্রতিবাদী পক্ষের হয়ে সওয়ালে ছিলেন অ্যাডভোকেট বলাই রায়।

কলকাতা হাইকোর্টের দুই বিচারপতির আদেশবলে, ২০০২ সালে তৈরী করা হয় পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। পাঁচজন সদস্যই ছিলেন স্বনামধন্য ঐতিহাসিক – নিমাইসাধন বসু, বরুণ দে, অরুণ কুমার দাশগুপ্ত, সুশীল চৌধুরী ও প্রদীপ সিংহ।

কমিটির কাছে জানতে চাওয়া হয় –

১। কলকাতার জন্মতারিখ কি ২৪শে আগস্ট ১৬৯০, না অন্য কোনও তারিখ?

২। জোব চার্নক কি কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা? তিনি না হলে প্রতিষ্ঠাতা কে?

অনুসন্ধানের পর, কমিটির সদস্যরা রিপোর্ট তৈরী করে ২০০২-এর নভেম্বরে হাইকোর্টে পেশ করেন।

রিপোর্টটিতে বলা হয় – কলকাতার নির্দিষ্ট কোনও জন্মতারিখ নেই। ২৪শে আগস্ট ১৬৯০ তারিখের অনেক আগে থেকেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। এবং, কলকাতার নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠাতাও নেই। জোব চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন।

১৬ই মে ২০০৩ তারিখে, অ্যাভোকেট বলাই রায় হাইকোর্টে জানান, রাজ্য সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টটিকে মেনে নিয়েছে। তখন বিচারপতি অশোক কুমার মাথুর ও বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাসের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেন যে, এরপর থেকে চার্নক-কে আর কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা বলা যাবে না। পাশাপাশি, কলকাতার কোনো জন্মদিন আছে – গ্রাহ্য হবে না এটাও।

রাজ্য সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে এরপর কলকাতার জন্ম-তারিখ ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জোব চার্নকের নাম পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য নথি থেকে মুছে দেয়। ইতিহাস বইয়েও এ-জাতীয় কোনো লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। ১৬ই মে আনন্দবাজার পত্রিকার হেডলাইন ছিল – ‘জন্মদিন নেই কলকাতার, জনকও নন জোব চার্নক’।

এ তো গেল আইনি ঘোষণা। কিন্তু বাঙালির মন থেকে কি কলকাতার জন্মদিনের তারিখটি মুছেছে? কলোনিয়াল হ্যাংওভার?

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Kolkata, #job charnock

আরো দেখুন