পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণকে বারংবার ব্যবহার করেছে বামেরা?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতায় থাকাটা বেশিরভাগ রাজনৈতিক পন্ডিতদের জন্য একটি রহস্য। এটা নিয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে, লেখাও হয়েছে। একটি রাজ্যের জন্য সম্ভাব্য প্রতিটি প্যারামিটারে নীচের দিকে থাকা সত্ত্বেও একটি সরকার কীভাবে এত দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে?
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অবনতি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা রোধ এবং ইউনিয়নবাদের আড়ালে গুন্ডাবাদের উত্থান সম্পর্কে প্রচুর লেখা হয়েছে। তবুও, প্রায়শই উপেক্ষা করা হয় এমন কিছু যা শুধুমাত্র কোনো সভ্য গণতন্ত্রের পরিবর্তে দেখা যায় আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত দেশগুলিতে – একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ধর্ষণের প্রবর্তন, লালন এবং স্বাভাবিককরণ। বামফ্রন্টের দ্বারা ধর্ষণকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার চল অনেক আগে থেকেই শুরু হয়। অভিযোগের পর অভিযোগ উঠেছিল যে রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে, ‘হার্মাদ বাহিনী’ (বিরোধীদের দেওয়া নাম) নিয়মিতভাবে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, পরিবার এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমর্থকদের নাকি গণধর্ষণ-সহ অশ্লীলতা মতো বর্বর কাণ্ড ঘটিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করত, এমনকি কারো বিরুদ্ধে একটি এফআইআরও করা হত না।
অশোককুমার নাইট, ১৯৬৮
১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে মেগা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘অশোক কুমার নাইটের আয়োজন করা হয়। সে রাতে সেখানে প্রায় ৫০,০০০ দর্শক ছিল। অভিযোগ উঠেছিল, পরের দু’দিনে রবীন্দ্র সরোবর (লেক) এর আশেপাশে কয়েক ডজন মহিলার ধর্ষিত নগ্ন লাশ পাওয়া গিয়েছিল। শোনা যায়, সিপিএম নেতারা (জ্যোতি বসু এবং অন্যরা) নাকি মহিলাদের এই গণধর্ষণ ও হত্যাকে “বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণীর উত্থান” বলে অভিহিত করেছিলেন এবং এই গণ-অপরাধকে ন্যায্যতা দিয়েছিলেন।
বানতলা কান্ড, ১৯৯০
অনিতা দেওয়ান (ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট এক্সটেনশন মিডিয়া অফিসার), উমা ঘোষ (সিনিয়র অফিসার, পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বিভাগ), রেনু ঘোষ (ইউনিসেফ এবং ডব্লিউএইচও প্রতিনিধি, দিল্লি), অবনী নাইয়া (চালক)। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, অনেক লোক তাঁদের নাম জানে না। এই মানুষগুলো কারা ছিলেন?
তারা কারা তা জানার জন্য ৩০ বছর আগের অভিশপ্ত ৩০ মে তে ফিরে যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ তখন জ্যোতি বসুর শাসনের অধীনে ছিল। বলা হয়, বাম শাসনের তথাকথিত স্বর্ণযুগে।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৩০শে মে ১৯৯০, গোসাবায় একটি টিকাদান কর্মসূচি শেষ করার পরে, তিনজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কলকাতায় ফিরছিলেন। সন্ধ্যা ৬.৩০ নাগাদ, যখন তারা ইস্টার্ন বাইপাস রোডে বানতোলায় পৌঁছান, তখন ৪-৫জন লোক সিপিএম পার্টি অফিসের কাছে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ড্রাইভার কিছু আন্দাজ করতে পেরে গাড়ি থামাননি। দুর্ভাগ্যবশত গাড়িটি পালানোর চেষ্টা করার সময় উল্টে যায় এবং সাথে সাথে আরও ১০-১২ জন লোক দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। গাড়ির ভেতরে থাকা লোকজনকে টেনে বের করা হয় এবং গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। চালক অবনি নাইয়া থামানোর চেষ্টা করলেও প্রতিবাদ করার শাস্তি হিসেবে উন্মত্ত মানুষগুলি তাঁর যৌনাঙ্গ পিষে ফেলে। পরে তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তার ময়নাতদন্তে শরীরে ৪৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। ১৯৯০ সালের ৪ জুন ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে অবনী নাইয়া মারা যান।
এই ছিল চালকের ঘটনা। বাকিদের কি হয়েছিল? কী বলছিল তখনকার সংবাদমাধ্যম?
তিন মহিলা অফিসারকে কাছের ধান ক্ষেতে টেনে নিয়ে গিয়ে গুন্ডারা গণধর্ষণ করে। যে ধর্ষকদের আটকানোর চেষ্টা করেছিল তাকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ ৫ ঘণ্টা পরে পৌঁছয় এবং ৩ মহিলার নগ্ন দেহ ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে স্থানান্তরিত করে। ডাক্তাররাও ভেবেছিলেন যে তিনজনকেই মৃত আনা হয়েছে। যাইহোক, শীঘ্রই তারা বুঝতে পারলেন যে তিনজন মহিলার মধ্যে দু’জন তখনও বেঁচে আছেন এবং তাদের চিকিৎসা শুরু হয়।
নিহত নারীর নাম অনিতা দেওয়ান। যখন তাঁর ময়নাতদন্ত চলছিল, তখন ময়নাতদন্তকারী মহিলা চিকিৎসক অনিতা দেওয়ানের গোপনাঙ্গে এক ফুট লম্বা ধাতব টর্চ দেখতে পেয়ে ঘটনাস্থলেই অজ্ঞান হয়ে যান।
পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রশান্ত সুর বলেছিলেন যে গ্রামবাসীরা মহিলাদের শিশু অপহরণকারী এবং পাচারকারী হিসাবে ভুল করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন – এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকে।
কেন বানতোলায় গণধর্ষণ হল? জানা যায়, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডিরেক্টর ডি. বন্দোপাধ্যায়, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে অনিতা দেওয়ানের আলোচনায় হয়, যে ইউনিসেফের পাঠানো গ্রাম উন্নয়নের তহবিল সম্পূর্ণভাবে সিপিএম পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি অপব্যবহার করেছে।
অনিতা দেওয়ান তহবিলের এই অপব্যবহার সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন এবং গোসাবার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় প্রমাণ সংগ্রহ করে কলকাতায় ফেরার পথে গুন্ডাদের দ্বারা আক্রান্ত হন। গাড়িটি যখন পুড়িয়ে ফেলা হয়, তখন তাঁর সঙ্গে থাকা সব সংগৃহীত প্রমান পুড়ে যায়।
সিপিএম সরকারের কেলেঙ্কারি ফাঁস করার চেষ্টা করার জন্য অনিতা দেওয়ান কেবল তাঁর সমস্ত সংগ্রহ করা প্রমাণগুলিই হারিয়ে ফেলেননি, তিনি তার মর্যাদা এবং তাঁর জীবনও হারিয়েছিলেন।
ধানতলা কান্ড , ২০০৩
বামপন্থীদের দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকার সময়, তার দলের বেশ কয়েকজন ক্যাডারকে এই ধরনের অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, এটি নদীয়া জেলায় বামপন্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক কোন্দল ছিল যার ফলে ২০০৩ সালে কুখ্যাত “ধানতলা ধর্ষণ” ঘটেছিল বলে জানা যায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে। একটি বরযাত্রীর বাসকে পথে আটকে দেওয়া হয়েছিল, কমপক্ষে ছয়জন মহিলাকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল এবং বাসের চালককে হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পরে তদন্তে দেখা গেছে যে এটি এলাকার দুই শীর্ষস্থানীয় সিপিএম নেতার মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল। গভীর রাতে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাসে উঠার কথা ছিল এক সিপিএম নেতার পরিবারের। কিন্তু গুন্ডারা ভুল বাসে হামলা চালায়, তাদের টার্গেট করা বাসটি আসে কিছুক্ষণ পরে।
একজন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে বিবাদে জেতার সবচেয়ে ভাল উপায় হল তার পরিবারের সদস্যদের ধর্ষণ করা? সে সময় এরকমই প্রশ্ন তুলেছিল ওয়াকিবহাল মহল।
সিঙ্গুর, ২০০৬
২০০৬-২০০৮ সালের মধ্যে সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম হিংসার কাণ্ডের সময় গণমাধ্যমগুলি অবশেষে পদ্ধতিগত সমস্যাটি উপলব্ধি করে। অ্যামনেস্টির মতো সংস্থাগুলি সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম উভয় দিকেই ছুটে গিয়েছিল। সিপিএমের সশস্ত্র ক্যাডারদের দ্বারা ধর্ষণকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার ঘটনাগুলিকে ‘এক্সপোজ’ করার চেষ্টা হয়েছিল বলে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
১৮ ডিসেম্বর, ২০০৬। ১৬ বছর বয়সী তাপসী মালিকের পোড়া দেহ পাওয়া গেলে। ময়নাতদন্তে জানা যায় যে তাকে খুন করার আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং সিপিআই(এম) এর ক্যাডাররা তার দেহ পুড়িয়ে দিয়েছে। তাপসী সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে সমর্থন জোগাড় করতে একটি ছোট ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজ্য সরকার দ্রুত তার ভাই এবং বাবাকে খুনের মামলায় আটক করে!
বিরোধীরা অভিযোগ করেছিল যে সিপিএম তাপসীকে ধর্ষণ ও হত্যা করে এবং তারপর পুড়িয়ে দেয়। সিবিআই মামলাটি গ্রহণ করে এবং ২৪ জুন, ২০০৬-এ স্থানীয় সিপিএম নেতা দেবু মালিককে গ্রেপ্তার করে। চার দিন পরে সিপিএম জোনাল কমিটির সেক্রেটারি সুহৃদ দত্তকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নন্দীগ্রাম, ২০০৭
২০০৭-এ নন্দীগ্রামে, তখন একটি লাল-দুর্গ, সিপিআই(এম)-এর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আসনগুলির মধ্যে একটি। আর অভিযোগ অনুযায়ী এখানকার অপরাধগুলি আরও ভয়ঙ্কর ছিল।
সিঙ্গুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন একটি টাটা ন্যানো কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন সিপিএম সরকার ২০০৬ সালের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম SEZ স্থাপনের ঘোষণা করেছিল।
শিল্পের জন্য বেছে নেওয়া জায়গাটি ছিল নন্দীগ্রাম। এখানে তৃণমূল কংগ্রেস SEZ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। ২ জানুয়ারী, ২০০৭-এ, কৃষক এবং তৃণমূল সমর্থদের সঙ্গে সিপিএম ক্যাডারদের সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন বলে অভিযোগ।
কৃষকরা পরবর্তীতে এলাকাটি বন্ধ করে দেয়, এবং মার্চ ২০০৭ পর্যন্ত, কোনও বহিরাগতকে নন্দীগ্রামে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ১২ মার্চ, ২০০৭-এ, প্রতিবাদের নেতৃত্বদানকারী ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, ডিজিপি’কে একটি চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যে নন্দীগ্রামে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা চলছে বলে কোনও পুলিশি অভিযান চালানো হবে না।
১৪ মার্চ পুলিশ নন্দীগ্রামে প্রবেশের চেষ্টা করলে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পুলিশ গুলি চালায়, এতে ১৪ জন নিহত হন।
তৎকালীন বাম সরকারের পক্ষে দাবি করা হয়েছিল যে পুলিশ এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে মৃত্যু এবং পরবর্তী হিংসার ঘটনা ঘটেছিল। অভিযোগ ওঠে, পুলিশের সঙ্গে ৫০০ জনেরও বেশি সশস্ত্র সিপিআই(এম) কর্মী ছিল যারা উপরে পুলিশের শার্ট পরে থাকলেও নিম্নাঙ্গে ছিল প্রতিদিনের পোশাক এবং চপ্পল।
অভিযোগ ওঠেছিল, সিপিআই(এম)-এর সশস্ত্র ক্যাডাররা ৫০ জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করে। তাঁদের মধ্যে ৪৭ জন আদালতে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা এখনও বিচারাধীন, সুপ্রিম কোর্ট এখনও পর্যন্ত তাদের ৩ জনের জন্য ২ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়।
পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট সরকার শিল্প প্রকল্পের জন্য জমি বিক্রির বিরোধিতাকারী গ্রামবাসীদের হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে দলীয় কর্মীদের নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই সময় এই কথা বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলিও বলেছিল।