৮০-র ১৬ আগস্ট ডার্বিতে চলে গিয়েছিল ১৬ টি প্রাণ, সেই ঘটনা নিয়ে তৈরি হওয়া গানকে নিজেদের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ঢাকতে ব্যান করেছিল জ্যোতি বসুর সরকার
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ১৯৮০-তে শেষবারের মতো ডার্বির উন্মাদনা দেখেছিল ইডেন। ১৯৮০-র ১৬ আগস্টের দুই যুযুধানের খেলা দেখতে গিয়ে ১৬ জন দর্শক পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কজনক দিন সেটি, আর বাংলার জন্য দুঃখের দিন! মায়ের বুক ফাটা কান্নার দিন। অনেকেই মনে করেন রেফারি সুধীন চট্টোপাধ্যায় সে দিন শুরু থেকে ম্যাচের রাশ ধরে রাখতে পারেননি।
মোহনবাগানের বিদেশ বসুকে আটকাতে ইস্টবেঙ্গলের কোচ পিকে লেফট ব্যাক পজিশন থেকে দিলীপ পালিতকে সরিয়ে আনেন রাইট ব্যাক পজিশনে। দিলীপ পালিত ক্রমাগত বিদেশকে অকারণেই আঘাত করে যাচ্ছিলেন, ময়দানের গন্ডগোল ছড়িয়ে যায় গ্যালারিতেও।
প্রথম থেকেই বলি, কলকাতা ফুটবলের ইতিহাসের কলঙ্কজনক দিনে ইডেনে ছিল কলকাতা লিগের ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান ডার্বি ম্যাচ। সেই সময়, ইডেনে ক্রিকেট ও ফুটবল দুটো খেলাই হত, কারণ তখনও যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন তৈরি হয়নি। সেদিন সেই ম্যাচে মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন কম্পটন দত্ত ও ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন সত্যজিৎ মিত্র আর রেফারী ছিলেন সুধীন চট্টোপাধ্যায়। খেলা শুরু হবার কিছুক্ষণ পর ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড় দিলীপ পালিত অত্যন্ত বাজে ভাবে ফাউল করে বসেন মোহনবাগানের বিদেশ বসুকে। কিন্তু রেফারী সুধীন চট্টোপাধ্যায় ব্যাপারটা এড়িয়ে যান এবং দিলীপ পালিতকে কোনরকম সতর্ক করেননি সুধীন বাবু। গ্যালারীতে তখন মোহনবাগান সমর্থকরা রাগে ফুঁসতে লাগলো। ঠিক একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটে খেলার দ্বিতীয়ার্ধে! বিদেশ বসু ফাউল করে বসলেন ইস্টবেঙ্গলের দিলীপ পালিতকে। রেফারী সুধীন চট্টোপাধ্যায় বিদেশ বসুকে সটান লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে যেতে বললেন। ওদিকে মোহনবাগান গ্যালারি ততক্ষনে রাগে ফেটে পড়ছে, মোহনবাগান সমর্থকদের চিল চিৎকারে কানপাতা দায়। খেলা প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। তখন রেফারী সুধীন বাবু হয়ত চাপে পড়েই আরেকটা ভুল করে বসলেন, বিদেশ বসুর লাল কার্ডকে ব্যালেন্স করতে লাল কার্ড দেখিয়ে বসলেন দিলীপ পালিতকে। কোনমতে খেলা শেষ হয়েছিল ১-১ গোলে। কিন্তু ততক্ষনে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরাও ক্ষেপে উঠেছেন। এবার দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে প্রথমে বাক্য বিনিমিয় শুরু হয়, অচিরেই তা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সেদিন ইডেন ছিল দর্শকে ঠাসা। বিশৃঙ্খলা-হৈহট্টগোল বেঁধে যায়, প্রাণভয়ে বেশ কিছু সমর্থকদের কেউ কেই গ্যালারির দু-তলা থেকে একতলায় ঝাঁপ দিয়ে আহত হলেন, কেউ বা প্রাণ হাতে করে গ্যালারি থেকে বেরনোর সরু রাস্তা দিয়েই বেরোতে চেষ্টা করলেন, ভিড় জমে গেল। এতেই অনেকে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন, অন্য সমর্থকদের পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারালেন।
যার ফলে অকালে ঝরে যায় ১৬ টি প্রাণ! সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায় সেই দিন প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ১৬ জন ফুটবলপ্রেমী আর আহত হয়েছিলেন প্রায় শদেড়েক। ১৬ জন ফুটবলপ্রেমীর স্মৃতিতে ১৬ই আগস্ট দিনটিকে ফুটবল লাভার্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেছে আইএফএ। ১৯৮১ সাল থেকে দুঃখের সঙ্গে আজও কলকাতার ময়দান এই বেদনার দিনটি পালন করে। ঐ দিনে রক্তদান শিবির আয়োজিত হয়।
ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ১৭ই আগস্ট, ১৯৮১ সালে আকাশবাণীর উপেন তরফদারের উপস্থাপনায় ‘সংবাদ বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানে রেডিওতে ভেসে আসে ‘খো-কা খো-কা’ বলে এক বৃদ্ধের হাহাকার। হয়ত একমাত্র সন্তান হারানোর বুকফাটা আর্তনাদ সারা কলকাতকে কাঁদিয়েছিল। বিখ্যাত অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই অনুষ্ঠান শুনেছিলেন।
৮০-এই ঘটনার কয়েকমাস পর একদিন এইচ এম ভি-এর দমদম-এর রেকর্ডিং স্টুডিওতে কল্পতরু প্রোডাকশানের ‘টাকার ফানুস’ সিনেমার গান রেকর্ডিং হচ্ছিল। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, সুপর্ণকান্তির সুরে মান্না দে গাইছেন। রেকর্ডিংএর পর মান্না দে-র সাথে আড্ডায় যোগ দিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও তরুনকুমার। কথায় কথায় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন সেই বছর ১৬ই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার নিয়ে তিনি একটি কবিতা লিখেছেন। মান্না দে শুনতে চাইলে, সত্যবাবু তাঁর স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনালেন।
মান্না দে কবিতাটা শুনেই, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে কবিতাটি চেয়েনিলেন। বললেন, “আপনার কবিতাটা নিয়ে তো গান হতে পারে। আপনি কবিতাটা খোকাকে (সুপর্ণকান্তির ঘোষের ডাকনাম) দিয়ে দিন, ও গানটায় সুর করবে আমি গাইব।”
কথায় সুর দেওয়া হল, সমীর খাসনবীশের মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের এইচ এম ভি থেকে রেকর্ড হল সেই গান ‘খেলা ফুটবল খেলা’। গানটি ছিল ‘খেলা ফুটবল খেলা, খোকা দেখতে গেল, সেই সকালবেলা’। ১৯৮১ সালে সরস্বতী পুজোর ঠিক আগে কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবে রেকর্ডটির প্রকাশিত হয়েছিল। গানের প্রকাশ অনুষ্ঠানে তদানিন্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল স্নেহাংশু আচার্য, পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদেশ বসুসহ ক্রীড়া জগতের অনেকেই, সেদিন ঐ অনুষ্ঠানে ছিলেন, মান্না দেও উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, এই গানের সঙ্গে জড়িত কোন ব্যাক্তি কোন পারিশ্রমিক নেননি, বরং মান্না দে-র ইচ্ছেয় সেই গানের রেকর্ড বিক্রির সব টাকা ঐ ১৬ জনের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আজও ইডেনের সামনে দিয়ে গেলে দেখতে পাবেন, সেই ১৬ জনের নাম শ্বেতপাথরে খোদাই করা আছে, যারা সেদিন ফুটবলের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর থেকে ইডেনে ফুটবল ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল গানটি বাম রোষে পড়ে, কারণ এই এতো কান্ড যে ঘটে গেল, প্রশাসনের উপর দায় তো তার বর্তায়, কিছুটা হলেও প্রশাসনিক ব্যর্থতা তো ছিলই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে গানের রেকর্ড বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।