জাতীয় শিক্ষা নীতি – দিশাহীন, আকাশকুসুম কল্পনা?
করোনা আবহে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার ফলে এখন অনলাইনেই ক্লাস করতে বাধ্য হচ্ছে পড়ুয়ারা। কোনরকমে স্থগিত থাকা আইসিএসই, সিবিএসই, মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে দেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে নিয়ে আসা হল বড়সড় বদল। এখন প্রশ্ন উঠছে এর ফলে কতটা বদল আসবে শিক্ষাব্যবস্থায়? আদৌ কি উপকৃত হবে পড়ুয়ারা?
নয়া শিক্ষানীতিতে শিক্ষাক্ষেত্রে কী কী বদল আসতে চলেছে, সেই সম্পর্কে মোটামুটি সকলেই অবগত। আমরা আজ আলোচনা করব বিতর্কিত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে। প্রথমেই, যে প্রসঙ্গ উঠবে সেটি হল ভাষা শিক্ষা। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। যদিও পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্য সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল। এই নয়া নীতিতে সেই বিধান নরম করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাঁদের পছন্দমতো ভাষা রাখতে পারবে। তবে অবশ্যই একটি প্রথম তিনটি ভাষার মধ্যে দুটি ভাষাকে স্থানীয় হতে হবে। তবে, যাদের ট্রান্সফার চাকরি বা মা-বাবা বহুভাষিক (তামিল-বাঙালি) তাঁদের সন্তানদের ক্ষেত্রে ভাষার বিধান দেওয়া নেই এই নয়া নীতিতে।
শৈশবের শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রশংসনীয়। প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা যথাযথ হলে শিশুর স্বাস্থ্য ভাল হয়, স্কুলছুটের সম্ভাবনাও কমে। কিন্তু আগেও অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা ও শিশুপরিচর্যার সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার সমন্বয় কী ভাবে হবে, তার কোনও স্পষ্ট অভিমুখ কিন্তু বর্তমান শিক্ষাবিলে নেই।
উদ্বেগের দিকটি হল স্কুলের সংখ্যার সঙ্কোচন। নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, ত্রিশের কম ছাত্র থাকলে স্কুল চালানো আর্থিক দৃষ্টিতে লাভবান হয় না। তাই দুই বা ততোধিক স্কুলকে একসঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। পাটিগণিতের লাভ-ক্ষতির হিসেবে অনেকের কাছে এটা প্রশংসনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীত দিকটি যথেষ্ট উদ্বেগের। দেশের অধিকাংশ ছোট গ্রাম, ভৌগোলিক ভাবে প্রান্তিক অঞ্চলের শিশুদের শিক্ষার সুযোগকে ‘অলাভজনক’ তকমা দিয়ে কেড়ে নেওয়া। এতে শিক্ষার অধিকার ব্যাহত হবে না কি?
নয়া নীতিতে আগাগোড়া মানোন্নয়নের কথা বলা হলেও, কী করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব তার দিশা নেই। শিক্ষা-পরিকাঠামোর যাবতীয় ত্রুটিগুলিকে অগ্রাহ্য করে শিক্ষার মানোন্নয়ন অসম্ভব। বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিয়ে মেধা ও জ্ঞানের উৎকর্ষ কত দূর হবে?
স্কুলশিক্ষা সামাজিক ভেদাভেদ মোচনের, এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত হাতিয়ার। এক জন শ্রমজীবী বা কৃষকের সন্তান কী ভাবে উন্নত শিক্ষা পেয়ে দেশের প্রগতিতে অংশগ্রহণ করবে, এই শিক্ষানীতি সে বিষয়ে নিশ্চুপ। এই শিক্ষানীতি নতুন কোনও দিশা দিতে ব্যর্থ, বরং বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করতে সক্রিয়।