মহিষখাগী থেকে বর্গভীমা, পল্লীবাংলার কালীদের চেনেন?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলায় দিকে দিকে দেবী কালীর আরাধনা করা হয়। বাংলার নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একাধিক কালী।
বর্গভীমা:
৫১পীঠের অন্যতম তমলুকের দেবী বর্গভীমা। মঙ্গলকাব্য অনুসারে, এক সওদাগর সিংহল যাওয়ার পথে তমলুক বন্দরে নোঙর করেন। সে’সময় এক ব্যক্তিকে স্বর্ণকলস নিয়ে যেতে দেখেন তিনি। সওদাগর ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি জানান, জঙ্গলের ভেতর একটি কুয়ো রয়েছে, যার জলে পিতলের কলস ডোবালেই তা সোনার হয়ে যায়। এই কথা শুনে অনেক পিতলের কলসি কিনে তা ওই জলে ডুবিয়ে সোনা বানিয়ে তা বিক্রি করে বিপুল লাভবান হয়েছিলেন সওদাগর। ফেরার পথে তিনি কুয়োর পাশেই বর্গভীমা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
অন্য এক কাহিনিতে রয়েছে, তাম্রলিপ্তে ময়ূরবংশের দ্বিতীয় রাজা তাম্রধ্বজকে এক মেছুনি জঙ্গল পেরিয়ে মাছ দিতে আসত। মাছগুলোকে সতেজ রাখতে একটি গর্ত থেকে জল নিয়ে ছিটিয়েছিল সে। তাতে মাছগুলি আবার জীবন্ত হয়ে যায়। খবর পেয়ে রাজা এসে ওই জায়গায় একটি দেবীমূর্তি দেখতে পান এবং তিনি মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে বলেন, ধীবর সম্প্রদায়ের আরাধ্যা ‘ভীমা’ দেবীই ‘বর্গভীমা’। দেবী বর্গভীমা চতুর্ভুজা। নীচে রয়েছে শায়িত শিবের মূর্তি। মায়ের ডানহাতের উপরটিতে রয়েছে খড়্গ আর নীচেরটিতে ত্রিশূল। উপরের বাম হাতে খর্পর আর নীচের হাতে মুণ্ড। বর্গভীমার দু’পাশে শোভা পাচ্ছে দশভুজা মহিষমর্দিনী ও দ্বিভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি।
শিকলে কালী:
আড়াইশো বছর আগে মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ লালবাগের লালগোলায় নির্মাণ করেন এই কালী মন্দির। জনশ্রুতি অনুযায়ী, অবিভক্ত বাংলাদেশের কোনও এক জমিদারবাড়িতে দেবীর নিত্যপুজো হতো। অপুত্রক জমিদার মনস্থির করলেন তীর্থাবাস করবেন। যাওয়ার আগে যোগীন্দ্রনারায়ণকে সেই দারুবিগ্রহ দান করে দেন। সেই মূর্তি নৌকাযোগে এনে মন্দির নির্মাণ ও বিগ্রহ স্থাপন করে নিত্যপুজোর স্থায়ী ব্যবস্থা করলেন যোগীন্দ্রনারায়ণ। অন্যমতে, কালীমন্দির সংলগ্ন কলকলি দিঘি একসময় যুক্ত ছিল পদ্মার সঙ্গে। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে যোগীন্দ্রনারায়ণ জানতে পারেন দিঘিতে জলমগ্ন দেবীর অবস্থিতি। পরে তিনি বিগ্রহ উদ্ধার করে মন্দিরে স্থাপন করেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বিগ্রহ প্রথম প্রতিষ্ঠার সময় ছাগবলি হয় ১০৮টি। রক্তভেজা আঙিনার দিকে দেবী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুরোহিত শিকল বেঁধে দেন দু’হাতে। দেবীর হাত দু’টি জোড়বদ্ধ। এই কালী ‘শিকলে কালী’ নামে জনপ্রিয়।
ধন্বন্তরী কালী:
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর মজিলপুর এলাকার প্রাচীন কালী ধন্বন্তরী। কথিত আছে, ৪০০ বছরের পুরনো এই মন্দিরে দেবীর স্বপ্নাদেশ থেকে পাওয়া ওষুধ দেওয়া হয়। যা খেয়ে অসুস্থ, রোগে কাতর ভক্তরা সুস্থ হয়ে যান। ভক্তদের বিশ্বাস, গ্যাস, অম্বল থেকে শুরু করে বহু ভয়ানক রোগ দেবীর কৃপায় সেরে যায়। সেই কারণেই দেবীর নাম ধন্বন্তরী। আজও নিমকাঠের বিগ্রহ পূজিত হচ্ছে মন্দিরে। রাজেন্দ্র চক্রবর্তীর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে মা কালী তাঁকে একটি বাতের ওষুধ দেন, যা পানের মধ্যে দিয়ে খেলে বাত সেরে যায়। ধন্বন্তরীর মতো ওষুধ কাজ করত বলে কালী বিগ্রহটি ধন্বন্তরী নামে পরিচিত হয় আর মন্দিরের নাম হয় ধন্বন্তরী কালী বাড়ি।
নাককাটা কালী:
পুরুলিয়া শহরের মধ্য-পল্লির পাঁড়ে গলির একেবারে শেষ প্রান্তে নাককাটা কালী মন্দির অবস্থিত। কথিত আছে, আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে এই এলাকা ছিল জনমানবহীন। কালীপুজোর আগে এক রাতে ডাকাত দল এই এলাকায় হামলা চালাতে জড়ো হয়। আমন ধান কেটে লুঠ করার ছক কষে। বাধা হয়ে দাঁড়ান মা শ্যামা। ডাকাত দল তখন ক্ষুব্ধ হয়ে তলোয়ার দিয়ে মায়ের নাক কেটে দেয়। তারপর থেকে টিলার ওপরে পাথরের মূর্তিকে পুজো করা হয়। পাথরের গায়ে মায়ের যে অবয়ব ফুটে উঠেছে সেখানে শ্যামার নাক কাটা। কার্তিকের অমাবস্যা ছাড়াও সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবার পাথরের মূর্তিতে পুজো হয়। বলিও হয়।
শকুন্তলা কালী:
শকুন্তলা মায়ের পুজো শুরু করে একদল ডাকাত। ঠগি ও ডাকাতে ভরপুর ছিল গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চল। কোন্নগর ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা এলাকা। জঙ্গলের মধ্যে এলাকা ভাগ-ভাগ করেছিল বিভিন্ন ডাকাত আর ঠগিদের ডেরা। বৈশাখ মাসের কৃষ্ণা তৃতীয়া বা তার পরের শনিবার রাতে কালীকে পুজো দিয়ে সারা বছরের মতো ডাকাতির ব্যবসা শুরু করত ডাকাত ও ঠগির দল। অশ্বত্থ গাছের নীচেই ছিল মায়ের থান। এই থানেই পড়ে থাকত রক্তমাখা হাড়িকাট। গাছের ওপরে বাস করত দলে দলে শকুন, তাই থানের আরেক নাম শকুন্তলা মায়ের থান। সেই থেকে মায়ের নামও শকুন্তলা রক্ষাকালী মাতা। কথিত আছে, দেবী সূর্যের মুখ দেখেন না। নিয়ম মতো মূর্তি বানানো হয় সূর্যাস্তের পর। দ্বিতীয় প্রহর শেষ হলে পুজো শুরু আর সূর্যোদয়ের আগে দেবীর বিসর্জন হয়।
মহিষখাগী কালী:
শান্তিপুরের বিখ্যাত কালী হল মাতা মহিষখাগী। ৫৫০ বছর আগে কোনও এক তান্ত্রিক পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে সাধনা করতে করতে মায়ের রূপ দেখতে পান, সেই থেকেই এই পুজোর সূচনা। তান্ত্রিকের নাম আজও জানা যায়নি। এখানে মহিষ বলি হত। সেই থেকে মায়ের নাম মহিষখাগী। মাকে প্রথম পাটে ওঠানোর দিনে থাকে বিভিন্ন নিয়মরীতি। তার পরে মন্দির প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করে সেদিন ভোররাতে হয় দধিমঙ্গল। তারপরে অমাবস্যা শুরু হলে রীতি মেনেই পুজো করা হয়। পরের দিন পালন করা হয় বাসি বিয়ের রীতি। পুজো সম্পন্ন হওয়ার পর কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয় মাকে বিসর্জনের জন্য।
সাতভাই কালী:
প্রায় ১৬০ বছর আগে বনগাঁয় ইছামতী নদীর তীরে গভীর জঙ্গলে সাত ডাকাত ভাই এক বটগাছের নীচে কালীমূর্তি পুজো করত। তারপর তারা ডাকাতি করতে যেত। সাতভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত কালীবিগ্রহ বলে সাতভাইয়ের কালী থেকে বর্তমানে নাম দাঁড়িয়েছে ‘সাতভিয়া কালী’। সপ্তদস্যু ও তাদের এক ভগিনীর একনিষ্ঠ পূজার্চনায় দেবী এখানে জাগ্রত হয়েছিলেন। আজও এই দেবীস্থান পবিত্র বলে বিবেচিত হয়।
ভুসো কালী:
পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের খরমপুর গ্রামে লক্ষ্মীপুজোর পর নির্মাণ শুরু হয় প্রায় ৫০ ফুট উচ্চতার এক প্রতিমার। অল্প দিনে বিশালাকার প্রতিমা শুকোতে ব্যবহার করা হয় হ্যালোজেনের আলো। পুজোর দিন গভীর রাতে শেষ হয় মূর্তি তৈরি। রাতেই মাটির পাত্রে প্রদীপ শিখা থেকে জমা কালি নিয়ে রাঙানো হয় প্রতিমার শরীর। তারপর গয়না পরিয়ে চক্ষুদান করেন শিল্পী। কালীর রং প্রদীপের ভুসোর মতো বলে নাম হয়েছে ‘ভুসো কালী’। কয়েকশো ছাগ বলি হয় কালীপুজোর রাতে। গ্রামের সব বাড়িই একতলা। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, দেবী যেহেতু একতলায় থাকেন, তাই সিঁড়ি বেয়ে কেউ উপরে উঠলে দেবী রুষ্ট হন। কিছু বাড়িতে চিলেকোঠা অবশ্য আছে। তবে সেখানেও মই বা অন্য কোনও ভাবে ওঠা হয়। বছর কুড়ি আগে এক বাসিন্দা নিজের বাড়িতে সিঁড়ি করে উপরে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যে দিন সিঁড়ি ঢালাই হয় সেদিনই বাড়িতে আচমকা বাজ পড়ে দেওয়াল ফেটে যায়। এরপর থেকে আর কেউ সিঁড়ি তৈরি করার কথা ভাবেননি।
মণ্ডলা কালী:
সাড়ে তিনশো বছর আগে হাওড়া জেলার পাঁতিহাল গ্রামের বর্ধিষ্ণু ঘোষাল পরিবারে মা পূজিতা হতেন। পরিবারের এক পূর্বপুরুষ তন্ত্র সাধনা করতেন। পরিবারে মধ্যে মত বিরোধ হওয়ায় গৃহে কালীপুজো বন্ধ হয়। পাঁতিহাল গ্রামের রায় পরিবারের ধর্মপ্রাণ জমিদার স্বর্গত কালাচাঁদ রায়কে দেবী স্বপ্নে আদেশ দেন মণ্ডলা নামক স্থানে দিঘির পাশে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে। সেই মতো কালাচাঁদ রায় ঘোষাল পরিবারের দ্বিতীয় পুরুষ গৃহীসাধক রামশরণ ঘোষালের সহযোগিতায় পঞ্চমুণ্ডির বেদিতে জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলহারিণী অমাবস্যায় কালীপুজো শুরু করলেন কালাচাঁদ রায়। দেবী এখানে দ্বিভুজা, সমুদ্রের জলের মতো উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ। একহাতে ছিন্নমুণ্ড এবং অন্য হাতে রুধির পাত্র। জিহ্বা অপ্রকাশমান, দাঁতগুলো সামনের দিকে প্রকাশিত। তিনি সদাহাস্যময়ী। গলায় মুণ্ডমালা এবং কোমরে ছিন্ন নরহস্ত অনুপস্থিত। দেবীর বাঁ পা সামনে এবং ডান পা পিছনে। তিনি শবরূপী শিবের উপর দণ্ডায়মান।
খয়রা কালী:
যশোররাজ প্রতাপাদিত্যের পতনের পর ভবেশ্বর রায়,, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে ১৬১১ সালে চাঁচড়া-সহ নুরনগরের কয়েকটি পরগনা উপহার পান, সঙ্গে রাজা উপাধিও পান। জমিদারি পরিদর্শনে এসে চাঁচড়ার রাজা চালাঘরের পরিবর্তে উচ্চ ভিটায় মায়ের পাকা মন্দির ও পিছন দিকে ভোগ রাঁধার ঘর নির্মাণ করে দেন। পরবর্তীকালে কলকাতার জানবাজারের বাবু রাজচন্দ্র দাস ১৮০৪ সালে রাসমণিকে বিবাহ করে, এই জমিদারি পরিদর্শনে এসে মায়ের মন্দিরের জীর্ণ দশা দেখে পুনর্নির্মাণকরেন। কয়েক দিন রাজচন্দ্র ও রাসমণি সোনাবেড়িয়ায় (বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত) তাঁদের কাছারি বাড়িতে বসবাস করেন।
আজও বিথারী গ্রামে ঐতিহ্য মেনে রানি রাসমণির সংস্কার করা মন্দিরেই খয়রাকালীর পুজো হয়। উচ্চতায় দেবী সাড়ে তিন হাত। দক্ষিণাকালী তথা খয়রাকালীর আদেশে একসময় সোনাই নদীর খয়রা মাছ দিয়ে শুরু হয়েছিল দেবীপুজো। সে রীতি আজও বজায় রেখেছেন উত্তরসূরিরা। খয়রা মাছ দিয়ে পুজোর কারণে, দেবী খয়রাকালী নামে পরিচিত।