বাঁধনা পরব, বাংলা অন্যতম প্রাচীন এক পরব
সৌভিক রাজ
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: রাঢ় বাংলা ও সাঁওতাল পরগণার নিজস্ব এক লৌকিক উৎসব হল এই বাঁধনা পরব। যা বাংলার তথা দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাচীনতম সংস্কৃতির এক নিদর্শন। এই পরবের মধ্যে গ্রাম্য জীবনযাত্রাও ফুটে ওঠে। বাঁধনা আজও পালিত হয়ে আসছে এই বাংলায়। বাঁধনা পরব বা উচ্চারণ ভেদে বাঁদনা পরব; মূলত ঝাড়খণ্ড এবং বাংলার পুরুলিয়া জেলার কুড়মি, ভূমিজ, লোধা, মাহাতো প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষের একটি কৃষিভিত্তিক উৎসব। প্রতি বছর কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে অনুষ্ঠিত কালীপুজোর পরের দিন, অর্থাৎ প্রতিপদে বাঁধনা পরব আয়োজিত হয়। প্রকৃত অর্থে বাঁদনা-পরব হল আমন ধান চাষের শেষে গরুদের বন্দনা করে কৃতজ্ঞতা জানানোর রীতি। ‘বন্দনা বা বন্ধন’ থেকে হয়ত ‘বাঁদনা’ শব্দটি এসেছে। কারণ এই পরবের শেষ দিনে খুঁটিতে গরুদের বেঁধে রেখে, তাকে দিয়ে শারীরিক কসরৎ করানো হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাত থেকে শুরু হওয়া বাঁদনা পরব শেষ হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন।কালীপুজোর রাতে গান শুনিয়ে গরুর সেবা করা হয়, প্রতিপদের দিন হয় গোয়াল পুজো আর দ্বিতীয়ার দিন পরবের অন্তিম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘গরু খোঁটান’। জঙ্গলমহলবাসীদের বিশ্বাস অনুযায়ী, কালীপুজোর রাতে মহাদেব মর্ত্যলোকের প্রতিটি গোয়াল পরিদর্শনে আসেন। সেই কারণে নোংরা আবর্জনা সাফাই করে, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে গোয়ালঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়।বাঁদনা পরব যাঁরা উদযাপন করে, তাঁরা এই পরবেই নতুন জামাকাপড় পরেন। মহুল গাছের কড়চা ফল ও তিল একসঙ্গে পিষে যে তেল হয়, তা দিয়েই প্রদীপ জ্বালানো হয়। ওই তেল গরুর শিঙেও মাখানো হয়। অমাবস্যার দিনে প্রথমে গোয়াল ঘরের সবচেয়ে বৃদ্ধ গরু বা মহিষের শিংয়ে ওই কড়চার তেল মাখিয়ে, তারপর গোয়াল ঘরের অন্যান্য গরুদের শিংয়ে তেল মাখানো হয়। অমাবস্যার দিন বিকেলবেলায় গ্রামের মোড়ে গরুগুলিকে একত্র করা হয়। মাঠ ছাঁদনদড়ি ও বাঁধনদড়ির পুজো করা হয়। এই পুজোকে গোঠপুজো বলে। আলপনা আঁকা হয় এবং তার ভেতরে ডিম রেখে দেওয়া হয়। এরপর ঢাক, ঢোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হলে গরুগুলি ছুটোছুটি শুরু করে। এরমধ্যেই কোনও গরু সেই ডিম ভেঙে দেয়, সেই দিকে লক্ষ্য রাখা হয়। সেই গরুর মাথায় তেল, সিঁদুর ও ধানের শীষ দিয়ে সাজানো হয়। অমাবস্যার সন্ধ্যাবলায় বাড়ির বিভিন্ন অংশ, তুলসীতলা, কুয়োপাড়, জানলা প্রভৃতি স্থানে কাঁঠাল বা শাল গাছের পাতায় চালের গুঁড়ো রেখে ভিতরে সলতে দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। এই রীতিকে ‘কাচিজিয়ারি’ বলা হয়ে থাকে।রাতে বাড়ির গৃহিনীরা কুলোয় ধান, দূর্বা, আমের পল্লব, হলুদ জল ও ধূপ-ধূনো দিয়ে নতুন জামা কাপড় পরে, ছড়া সুর করে গেয়ে গরুকে বরণ করেন। গভীর রাতে গোয়ালে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালা হয় এবং উঠোনে কাঠের আগুন জ্বেলে রাখা হয়। যুবকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরুদের জাগিয়ে রাখেন। এই যুবকদের ধাঁগড়িয়া বা ধাঁগড় বলা হয়। ঢোল, মাদল, বাঁশি বাজিয়ে ‘লায়ার’ অর্থাৎ পুরোহিতের বাড়ি থেকে ‘ঝাঁগোড়’ বা জাগরণী গানের দল গ্রামের মধ্যে বেরিয়ে পড়েন। গ্রামের সব বাড়ি থেকে অন্তত একজন করে পুরুষ ওই দলে থাকেন। এই দলটি গ্রামের বা প্রত্যেক গৃহস্থের গোয়াল ঘরে গিয়ে গান করে।‘জাগে মা লক্ষ্মী জাগে মা ভগবতী, জাগে তো অমাবস্যার রাতিজাগে তো প্রতিপদ দেবে গো মাইলানি, পাঁচ পুতাঞঁ দশধেনু গাই।’তারা অহীরা গান করতে করতে বাজনা বাজিয়ে বাড়িতে গেলে গৃহস্থরা তাদের স্বাগত জানান। গৃহবধূরা পিটুলী গোলার দিয়ে ধাঁগড়িয়াদের সঙ্গে হোলি খেলেন।
অমাবস্যার রাতে ‘ঝাঁগোড়া পিঠা’ বানানো হয় ও গানের দলকে সেই পিঠে খেতে দেওয়া হয় এবং গরুকেও ওই পিঠে খাওয়ানো হয়। পিঠে বানানোর জন্য কেবলমাত্র ঢেঁকিতে কোটা চালের গুঁড়ি লাগে।অমাবস্যার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদে লাঙল, জোয়াল, মই প্রভৃতি চাষের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে বাড়ির উঠোনের তুলসী তলায় রাখা হয়। প্রতি বাড়ির গৃহকর্তারা জমি থেকে এক আঁটি ধান কেটে এনে, ধানের শীষ দিয়ে গহনা তৈরী করে গরু বা মহিষের শিংয়ে পরিয়ে দেন। এরপর চাষের যন্ত্রপাতিগুলিকে পুজোর পরে ঘরের ছাদে রেখে আসা হয় এবং মাঘ মাসের প্রথম দিনে হালপুহ্নের দিনে নামিয়ে আনা হয়। প্রতিপদের দিন সকালে হয় ‘গোয়াল পূজা’। চালের গুঁড়োর সঙ্গে পাইনা লতা নামে জঙ্গলের এক ধরনের পিচ্ছিল লতা বেটে উঠোনের দরজা থেকে গোয়াল ঘর ও প্রতিটি ঘরের সামনে আলপনা দেওয়ার রীতি রয়েছে। আলপনার মধ্যে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। গোয়াল ঘরের এককোণে তিনটি কাঁচা মাটির মণ্ডর মধ্যে ডাঁটা সমেত তিনটি সাদা শালুক ফুল রাখা হয়। গৃহপালিত পশুদের মঙ্গল কামনায় নিবেদন করা হয় আতপ চাল ও ফল-মিষ্টির নৈবেদ্য। ব্যাঘ্রদেবতা বা ‘বাঘুত’-এর সন্তুষ্টির জন্য কেউ কেউ গোয়াল ঘরে পাঁঠা বা মোরগ বলি দেন। বাড়ির গৃহিনী ও অন্যান্য মহিলারা স্নান করে গোয়াল ঘরের মধ্যেই উনুন বানিয়ে মাটির মালসায় মালপোয়া জাতীয় পিঠে বানান। চালের গুঁড়ো, আখের গুড় ও দুধ দিয়ে মেখে এক হাতা করে গরম ঘিয়ে ভেজে তোলা হয় এই ‘গরৈয়া পিঠা’।সাধারণত ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে বাঁদনা পরবের শেষ পর্যায় গরু খোঁটানে বা গরুখুঁটা বা কাড়াখুঁটা বা বুঢ়ীবাঁধনা নামক এক আচার পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে কিছু গরু বা মহিষকে নির্বাচন করে তাদের গায়ে লাল ছোপ এবং কপাল ও শিংয়ে তেল ও সিঁদুর লাগিয়ে গলায় মালা, ঘণ্টা ও ঘুঙুর বেঁধে তাদের খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়। এরপর গরুর সামনে মহিষের চামড়া টানিয়ে রেখে চারদিক থেকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গরুগুলিকে উত্তেজিত করলে সেগুলি চামড়াগুলিকে গুতো দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সমবেত জনতা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।গরু খোঁটান-এর সময় সমবেত গান করা হয়,‘এতদিন চরালি ভালা, কোচাখুঁদি রে, আজ তো দেখিব মরদানিচার ঠেঙে নাচবি, দুই শিঙে মারবি, রাখিবি বাগাল ভাইয়ের নাম।’এই গানকে অহীরা গান বলা হয়, এর সঙ্গে নাচও করা হয়।বাঁদনা পরবের গান হল,‘কনও নদী বহে হবকি ডবকিয়া কনও নদী বহেই নিরাধারকাঁসাই নদী বহে হবকি ডবকিয়া সবন্নখা বহে নিরাধার।’এই অহীরা গান গরুদের জাগরণের উদ্দেশ্যে পুরুষরা সমবেত ভাবে মাদল, ধামসা, ধোল, ঝুমকা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহকারে গেয়ে থাকে। রাখাল বা পশুপালক শ্রেণীর এই সকল গায়কদেরই স্থানীয়দের ভাষায় ধাঁগড় বলা হয়। কৃষি সহায়ক গোরুদের কৃতজ্ঞতাপূর্বক স্তূতি, গৃহস্থের সমৃদ্ধি কামনা এবং গৃহকর্তার নিকট অর্থ প্রত্যাশাই এই গানের বিষয়বস্তু। অহীরা গানের ধারা সুপ্রাচীন। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া এই গান গাওয়া হয় না। এই গান লিখে রাখাও হয় না। এই গানের সুরেরও খুব একটা বৈচিত্র্য হয়না।এই গান গাওয়ার একটি নির্দিষ্ট রীতি রয়েছে, একটি স্তবক গাওয়ার পর বাদ্যযন্ত্রগুলি বাজানো হয়, আবার বাজনা বন্ধ হওয়ার পরে আবার গান গাওয়া হয়। গান শেষে চলে যাওয়ার সময় তাঁদের খাদ্য ও দক্ষিণা হিসেবে অর্থ প্রদান করা হয়। গরু জাগরণের গান ছাড়াও কথোপকথনমূলক বা প্রশ্নোত্তরমূলক অহীরা গানও গাওয়া হয়। গানে গরুর জীবন, প্রয়োজনীয়তা এবং চাষে তাদের ভূমিকা এই সব বিষয় গুলি প্রশ্নোত্তর পর্বের মতো করে গাওয়া হয়ে থাকে। আচারধর্মী এই সমস্ত গানের ভাষায় মৈথিলী ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয়, অপরিবর্তনশীল ও লুপ্ত প্রায় প্রাচীন এক ভাষায় এই গান গাওয়া হয় বলে গানের অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই বোঝা যায় না।এই বাঁধনা পরবের সাথেই অনুষ্ঠিত জামাই বাঁধনা উৎসব, অনেকটা জামাই ষষ্ঠীর মতোই এটি একটি জামাই আপ্যায়নের প্রথা।ছাং গরগর আইসকা পিঠা,দেখ্ ন জামাই কেমন মিঠা।।বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান ও পূর্ব মেদিনীপুরের এক বিখ্যাত লোকাচার এই জামাই বাঁধনা। বাঁধনা পরবের অংশ হিসেবে যেমন ; ঐ দিন গ্রামের চাষ বন্ধ করে গরু মহিষদের পুজো করা হয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ে জামাই কে নতুন বস্ত্রাদি প্রদান করে, তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করে, বরন করার রীতি প্রচলিত আছে। মূলত সাঁওতাল পরগনার এই রীতি হলেও দীপাবলির পরের দিন এবং ভাইফোঁটার আগের দিন প্রতিপদের পূন্যলগ্নে রাঢ় বাংলার অনেক পরিবারেই এই উৎসব আয়োজিত হয়। এই রীতিতে মেতে ওঠেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র সকলেই। বাঁধনা পরবের অংশ হিসেবেই কার্তিক মাসের অমাবস্যার পরের প্রতিপদ তিথিতে উদযাপিত হয় জামাই বাঁধনা।