আজ ভাঙা রাস, রাইরাজাদের দেখতে ভিড় উপচে পড়বে শান্তিপুরে

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের শাসনকালে, ভাঙা রাসকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে।

November 17, 2024 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi
আজ ভাঙা রাস, রাইরাজাদের দেখতে ভিড় উপচে পড়বে শান্তিপুরে

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: কার্তিক পূর্ণিমাতে পালিত হয় রাস। মূলত দু-দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠান একেবারে অন্য রকম মন্তাজে পালিত হয় নদীয়ার শান্তিপুরে। এখানে রাস তিন দিনের, শেষের দিনটিই আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্র, ভাঙা রাস। ইতিহাস বলছে, শান্তিপুরে রাসের সূচনা করেন অদ্বৈতাচার্য। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্য অগ্রজ বিশ্বরূপের অধ্যাপক। ১৪৩৪ সালে অধুনা বাংলাদেশের লাউরে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অদ্বৈতাচার্য। মাত্র দশ বছর বয়সে নবদ্বীপে চলে এলেও পরে তিনি শান্তিপুরেই থাকতেন।

বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ একটি শর্তে রাসলীলা করতে রাজি হয়েছিলেন, বলেছিলেন রাসমঞ্চে তিনিই একমাত্র পুরুষ থাকবেন। শর্ত মেনে রাসলীলা শুরু হয়। কিন্তু রাসে কী হয় দেখার জন্যে মহাদেব নারীর ছদ্মবেশে রাসমঞ্চে প্রবেশ করেন। শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারেন দ্বিতীয় পুরুষের আগমন ঘটেছে, শ্রীকৃষ্ণ রাস মঞ্চ ত্যাগ করেন। মহাদেবের আর রাস চাক্ষুষ করা হয় না। ক্রোধে মহাদেব বলেন, রাস লীলা শিব তাঁকে দর্শন করতে দিল না, সেই রাসলীলা তিনি কলিযুগে আচন্ডাল ভক্তদের দেখাবেন। এরপর কলিযুগে অবতীর্ণ হলেন কমলাক্ষ মিশ্র। তিনি মহা-বিষ্ণু অর্থাৎ মহাদেব এবং বিষ্ণুর মিলিত রূপে শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্য রূপে প্রকট হন। তিনিই সর্বপ্রথম রাস উৎসবের সূচনা করেন। তারপর থেকেই রাস হয়ে ওঠে সকলের উৎসব।

প্রথমে শান্তিপুরের রাস উৎসবও দু’দিনের ছিল। প্রথম রাস এবং দ্বিতীয় রাস। তারপর রাস উৎসবের তিনটি পর্যায় হল, বসা রাস, ভাঙা রাস ও কুঞ্জভাঙা। মূল রাসের অনুষ্ঠানকে বসা রাস বলা হয়। বসা রাসের মিটলে মঞ্চের বিগ্রহকে নিয়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে নগর পরিক্রমা করানো হয়, যা ‘ভাঙা রাস’ নামে পরিচিত। তারপর রাসমঞ্চ থেকে মূল মন্দিরে বিগ্রহের ফিরে যাওয়াই কুঞ্জভাঙা। বিগ্রহ বাড়ির ক্ষেত্রেই মূলত কুঞ্জভাঙা পর্ব দেখা যায়। কারণ বারোয়ারি রাসের কোনও স্থায়ী মন্দির থাকে না।

ইতিহাস বলছে, বারো ভুঁইঞার অন্যতম প্রতাপাদিত্য, পুরীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে পূজিত দোলগোবিন্দের বিগ্রহ যশোরে নিয়ে আসেন। কিন্তু মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে প্রতাপাদিত্য সেই বিগ্রহ তুলে দেন বারো ভুঁইঞাদের গুরু অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে। তিনি সেই বিগ্রহকে শান্তিপুরে নিয়ে এসে রাধারমণ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু মথুরেশ গোস্বামীর মৃত্যুর পর সেই বিগ্রহ একদিন চুরি হয়ে যায়। স্থানীয় এক ব্যক্তি স্বপ্নাদেশ পান, তারপর দিগনগরের বিল থেকে ওই মূর্তি উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় গোস্বামীদের মনে হয়, মাধব রাধা বিনা কষ্ট পাচ্ছেন। তাই প্রতিষ্ঠা করা হয় রাধা দেবীকে। এরপর রাসের দিন তারা মিলিত হয়। গোস্বামীদের শিষ্য খাঁ চৌধুরীদের প্রস্তাবে রাসের এই দৃশ্য শোভাযাত্রা হিসেবে দেখানো হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। যা ভাঙা রাস নামে প্রচলিত।

শান্তিপুর বড় গোস্বামী বাড়ির রাধারমণ এক সময়ে একাই মন্দিরে পূজিত হতেন। রাধারানী ছিলেন না। সেই সময় প্রায়ই শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ হারিয়ে যেত বা অপ্রকট হত। কাত্যায়নী পুজোর মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ ফেরত আনা হত। সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজতে তখন শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্যরা প্রস্তাব করেন, হয়ত রাধারানীকে আনলে কৃষ্ণের সংসারে মন বসবে, তিনি আর মন্দির ছেড়ে যাবেন না। রাধারানীর মূর্তি গড়ানো হয়। রাস উৎসবের সময় তা প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেবার দ্বিতীয় রাসের পরের দিন শান্তিপুর বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্যরা মিলে রাধা এবং কৃষ্ণের মূর্তি নিয়ে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা আয়োজন করেন। শান্তিপুরের অন্যান্য বিগ্রহ বাড়ি সেই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। এইভাবেই ভাঙা রাসের সূচনা হয়।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের শাসনকালে, ভাঙা রাসকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। কতকটা হিংসায়, রাসের সময় নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর আসার জলপথ এবং স্থলপথে অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দেন কৃষ্ণচন্দ্র। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই কর দেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে শান্তিপুরের ভাঙারাসে ভিড় কমতে আরম্ভ করে। নবদ্বীপে জমায়েত বাড়তে থাকে। ভিড় ফিরিয়ে আনার উপায় খোঁজা হল। ঠিক হল এবার থেকে থেকে বিগ্রহের সঙ্গে রাইরাজা বেরোবে। বৃন্দাবনে যখন শ্রীকৃষ্ণ রাস মঞ্চ ত্যাগ করেছিলেন তখন স্বয়ং রাধারানী রাজা সেজেছিলেন। সেই ঘটনার প্রতীক হিসাবে কুমারী মেয়েকে রাজা সাজিয়ে পুজোর পর বিগ্রহের সামনে সিংহাসনে বসিয়ে ভাঙা রাসের শোভাযাত্রায় বের করা হয়। এ জিনিস চালু হতেই শান্তিপুরের ভাঙারাসে ভিড় বাড়তে থাকে। আজও বিগ্রহের সঙ্গে রাইরাজা বের হন। বর্তমানে রাসের শোভাযাত্রায় ১২ বছরের কম বয়সীদের রাইরাজা সাজানো হয়। রাইরাজা হওয়ার অন্যতম শর্ত হল ব্রাহ্মণ পরিবারের হতে হবে। শোভাযাত্রার আগের রাতে নিরামিষ আহারের পর শিশু কন্যাদের সাজিয়ে বিগ্রহের সামনে বসিয়ে শুরু হয় রাসযাত্রা। আজও মানুষ রাইরাজাদের আকর্ষণে শান্তিপুরের রাস উৎসবে ভিড় জমান।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen