আয়ুর্বেদেই রোগমুক্তি
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: আয়ুর্বেদকে আধুনিক যুগে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ওষুধের সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সুস্থ ব্যক্তি বা অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্যই এর সামগ্রিক পদ্ধতি অতুলনীয়। রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি আয়ুর্বেদের প্রধান লক্ষ্য। ভগবান ধন্বন্তরীকে আয়ুর্বেদের ঐশ্বরিক প্রচারক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাকে স্বাস্থ্য ও সম্পদ প্রদানের গুণাবলিতে ভূষিত করা হয়।
আয়ুর্বেদ ভারতের গর্ভজাত পৃথিবীর প্রাচীনতম চিকিৎসাবিজ্ঞান যা হাজার হাজার বছরের তৎকালীন বৈজ্ঞানিক চিন্তা, নিরন্তর গবেষণা ও অসংখ্য চিকিৎসালব্ধ অভিজ্ঞতার জ্ঞানসমুদ্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এই ভারতীয় সংহিতাসমূহ শুধু জাতি বা দেশ নয় বিশ্বের অন্যতম গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে বহুল পরিচিত যা বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানকে পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রকাশে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে এসেছে।
আয়ুর্বেদ শব্দের মূল অর্থই হচ্ছে জীবন সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান অর্থাৎ কেবলমাত্র রোগ নিয়ে কাজ নয়। রোগীর শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গরূপে সুস্থতা রক্ষায় এক সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলি দ্বারা জীবনের গতিপথে রোগমুক্ত থাকা। কয়েকটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার হয়, যেমন
১. সুস্থতার প্রথম সূত্র সর্বপ্রথমে নিদান পরিবর্জন: আয়ুর্বেদ মতে যেকোনও অসুস্থতা তা শারীরিক হোক বা মানসিক তার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে যেটা চিহ্নিত করে সর্বাগ্রে সেই কারণসমূহ বর্জন করায় এককথায় নিদান পরিবর্জন যা এই আয়ুর্বেদ চিকিৎসার অভ্রান্ত সিদ্ধান্ত বা মূল স্তম্ভ কারণ নিদান গ্রহণের পাশাপাশি কোনভাবেই সুচিকিৎসা হতে পারে না। এই ভিন্নতা, এই দৃষ্টিকোণ অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আয়ুর্বেদকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
২. রোগা সর্বাদপি মন্দাগ্নি…
আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘রোগা সর্বাদপি মন্দাগ্নি…’ বলে একটি কথা আছে যার অর্থই হল সর্ব প্রকার রোগের মূল ও প্রাথমিক কারণই হচ্ছে এই মন্দাগ্নি। শুনতে অবাক লাগলেও এই মন্দাগ্নি থেকে হতে পারে না এইরকম রোগ প্রায় নেই বললেই চলে এবং অগ্নির অসাম্যতা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনযাত্রায় মানুষ যতটা অভ্যস্ত হচ্ছে ততটাই বদলে যাচ্ছে খাদ্যাভাস, সঠিক জল পানের নিয়ম, খিদে না পাওয়া সত্বেও খাওয়ার অভ্যেস এবং সর্বোপরি নিয়মিত বাইরের অতিরিক্ত তেল মশলা জাতীয় খাওয়ারের কুপ্রভাব। ফলে বহুবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে অহরহ। এখানে আয়ুর্বেদ সিদ্ধান্ত হলো সুস্থতা রক্ষায় অগ্নির সাম্যতা জরুরি।
৩. কখন কীভাবে কতটা জল পান:
সামগ্রিকভাবে জল পানের ক্ষেত্রে আয়ুর্বেদের এক বিশেষ নীতিমালা রয়েছে:
‘অজীর্ণে ভেষজং বারি জীর্নে বারি বলপ্রদম।
ভোজনে চামৃতং বারি ভোজনান্তে বিষপ্রদম।।’
অর্থাৎ অজীর্ণ রোগের ক্ষেত্রে জল পান প্রধান ওষুধ, খাওয়ার জীর্ণ হাওয়ার পর জল পান শরীরে বল প্রদান করে। খাদ্য গ্রহণের সময় জলপান অমৃতসম কিন্ত ভোজনের তত্ক্ষণাত্ পর জলপান বিষের মতো ক্ষতিকর।
শুধুমাত্র প্রতিদিন এই নিয়মটি মেনে চললে বহুবিধ সমস্যা থেকে অচিরে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
৪. বিরুদ্ধ আহার ও তার ভয়াবহতা: এমন কিছু খাদ্য দ্রব্য রয়েছে যা একসঙ্গে সেবন করলে শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়,হতে পারে দুরারোগ্য রোগব্যাধি।
যা অধিকাংশ মানুষ হয়তো জনেই না।
দুধের সাথে কাঠাল,মাছ,লবন,খিচুড়ি, মুলা,জাম,ছাতু,তরমুজ ইত্যাদি।
দইয়ের সঙ্গে ক্ষীর,পনীর,দুধ,গরম পদার্থ, কলা ইত্যাদি।
ঘি ও মধু মাত্রামাত্রায় সেবন নৈব নৈব চ।
তামার পাত্রে ঘি, গরম মধু সেবন, রাতে ছাতু খাওয়া, পায়েস ও ঘোল একসঙ্গে সেবন, পুঁইশাকের সঙ্গে তিল ইত্যাদি সবগুলোই বিভিন্ন প্রকার বিরুদ্ধ আহার।উপরের খাদ্যগুলো একসাথে সেবন করলে তাদের নিজেদের রসয়ানিক বিক্রিয়ার ফলে শরীরে বিভিন্নরকম ক্ষতিকারক প্রভাব দেখা যায়।
চরক সংহিতা মতে বিরুদ্ধ আহার সেবন ত্বকের সমস্যা,পেটের বিভিন্ন রোগ,জ্বর,বন্ধ্যাত্ব,উন্মাদ,অন্ধত্ব ইত্যাদি হতে পারে।
৫. নিত্য সেবনীয় পথ্য-অপথ্য:
আমাদের দৈনন্দিন সেবনীয় আহার্য দ্রব্যের সাথে পরিপাকক্রিয়ার এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে সেই দৃষ্টিকোণে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের চরক সংহিতা মতে নিত্য সেবনীয় ও বর্জনীয় খাদ্য তালিকা অনুযায়ী,শালি চাল, মুগ, সৈন্ধব লবণ, আমলকী, যব, দুধ, ঘি, মধু রুক্ষ এলাকার প্রাণীর মাংস ইত্যাদি নিত্য সেবনীয় দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে মাছ, দই, মাষকলাই ইত্যাদির নিত্য সেবন শরীরের পক্ষে হানিকরক।
এছাড়াও অধিক গরম, টক ও নোনতা জাতীয় খাদ্যদ্রব্য, শীতল এবং গুরু দ্রব্য, তেলে পাক করা পুরি, মালপুয়া, শাক সেবন। দিবানিদ্রা,অত্যধিক শারীরিক পরিশ্রম এবং যে কোনও নেশা পেটের সমস্যা তথা উদর রোগের ক্ষেত্রে একেবারেই পরিতাজ্য।
৬. অধ্যসন অর্থাৎ (খিদে না পেলেও খাওয়া) হরেক রোগের আঁতুড়ঘর: আধুনিক ব্যস্ততাময় জীবনযাত্রায় খিদে পেলে সময় খাওয়া ব্যাপারটা অনেকেরই ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে না আবার অনেকের ক্ষেত্রে আগের খাওয়া হজম হওয়ার পূর্বেই অনেকে খেয়ে থাকেন। উপরের দুই ক্ষেত্রেই শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় এবং এই অভ্যেস দীর্ঘকালীন হলে বিভিন্ন প্রকার রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
আয়ুর্বেদ দৃষ্টিকোণে খিদে পেলে তবেই খাবার খাওয়ার নির্দেশ রয়েছে এবং সর্বদা ত্রিবিধ কুক্ষী বিমান অনুযায়ী অর্থাৎ পেটের একভাগ খাদ্যদ্রব্য (ভাত, রুটি, শাক ইত্যাদি) একভাগ তরল পদার্থ (জল, দুধ ইত্যাদি) এবং একভাগ ফাঁকা রেখে খাওয়া উচিত। এককথায় উদরপূর্তি করে খাওয়া উচিত নয়।