মন পড়ে নিচ্ছে যন্ত্রমেধারা 

ফেসবুকের পর্দায় আসা অ্যাপে ঢুকে তাঁরা যখন নিজের পছন্দ-অপছন্দ জানাচ্ছেন, তখন যন্ত্রমেধা তাঁদের সাইকোলজিক্যাল প্রোফাইল বা মানস-অবয়ব তৈরি করে ফেলছে। অজান্তে, আড়ালে।

September 24, 2020 | 2 min read
Published by: Drishti Bhongi

মন খুলে দেখো। দুনিয়া খুলে যাবে। ফেসবুকের সাম্প্রতিকতম বিজ্ঞাপনী বার্তা। বছর ক’য়েক আগে এমন সোজা বিজ্ঞাপন না থাকলেও বার্তাটা ছিল একই— নিশ্চিন্তে মনের কথা প্রকাশ করুন দুনিয়ার কাছে। ফেসবুকে নানা অ্যাপে মনের কথা জানিয়েছিলেন আমেরিকার আট কোটিরও বেশি বাসিন্দা। তখন তাঁরা বুঝতেও পারেননি, তাঁদের মন পড়ে নিচ্ছে যন্ত্রমেধা। টেরও পাননি, ফেসবুকের পর্দায় আসা অ্যাপে ঢুকে তাঁরা যখন নিজের পছন্দ-অপছন্দ জানাচ্ছেন, তখন যন্ত্রমেধা তাঁদের সাইকোলজিক্যাল প্রোফাইল বা মানস-অবয়ব তৈরি করে ফেলছে। অজান্তে, আড়ালে।

তখনও জানা যায়নি সেই কোটি কোটি মানস-অবয়বের চরিত্র বুঝে তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার চালানো হবে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে। ট্রাম্প জেতেন। তারপরে ফাঁস হয়, ফেসবুক থেকে তথ্য নিয়ে এই ডিজিটাল প্রচারের নকশা। সেই নকশা করেছিল অধুনালুপ্ত ব্রিটিশ সংস্থা— কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। ২০১৬-র নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচারের দায়িত্বে ছিল তারাও। 

ঘটনা জানাজানি হতে হইচই পড়ে বিশ্বজুড়ে। গ্রাহকদের না জানিয়ে তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্যের এমন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইতে হয় ফেসবুক কর্ণধার মার্ক জ়াকারবার্গকে। বন্ধ হয়ে যায় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। তবে বোতল থেকে বেরিয়ে পড়ে ঘুমন্ত দৈত্য। বিশ্বকে জানিয়ে দেয়, সমাজমাধ্যমে নাগরিকদের বিচরণের চিহ্ন রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থেও ব্যবহার হতে পারে। হচ্ছেও।  

নব্বইয়ের দশকে একটা বিজ্ঞাপনী বাক্য জনপ্রিয় হয়েছিল— ভিকি জানেই না যে ও মার্জারিন খাচ্ছে। মাখনের মতো স্বাদ বলে ভিকি বুঝতেই পারে না মাখন আর মার্জারিনের তফাত। সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অবস্থাও ভিকির মতোই। তাঁরা জানেনই না, সামাজমাধ্যমে অকাতরে দেওয়া তাঁদের মন-মানসিকতা বা প্রবৃত্তির চিহ্ন পুঁজি হয়ে গিয়েছে বৃহৎ সংস্থাগুলির কাছে। পরিভাষায় এই পরিচয় বা প্রবৃত্তির নিক্তিকে বলে ‘ডেটা পয়েন্ট’। যেমন ফেসবুকে এই ডেটা পয়েন্ট আসে কেউ কী ‘লাইক’ করছেন, কী করছেন না, কী মন্তব্য করছেন, কোনও অ্যাপে কোনও প্রশ্নের কী উত্তর দিচ্ছেন— এ সব থেকে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা দাবি করেছিল, প্রত্যেক ভোটারের ৫০০০ ডেটা পয়েন্ট তাদের কাছে মজুত ছিল।

কতটা ডেটা পয়েন্ট পেলে তবে মানুষ চেনা যায়? গবেষণা বলছে, ফেসবুকের যন্ত্র মেধার প্রযুক্তি বা অ্যালগরিদম দশটা ‘লাইক’ থেকে কাউকে চিনতে পারে তার সহকর্মীর মতো। দেড়শো লাইক পেলে নাকি কাউকে তার মা-বাবার থেকেও ভাল চেনা যায়। তিনশো লাইক থেকে কারও ব্যক্তিত্বের এমন আন্দাজ করা সম্ভব, যা নাকি তাঁর জীবনসঙ্গীও পারবেন না। তাই প্রত্যেক ভোটারের ৫০০০ ডেটা পয়েন্ট থেকে তার মনস্তত্ত্বের কত গভীরে পৌঁছনো যেতে পারে তা শিউরে ওঠার মতো।

এ ভাবে মন পড়েই নিশানা করা হয় সেই সমস্ত ভোটারদের, যাঁরা দোলাচলে রয়েছেন। যাঁদের প্রভাবিত করা সম্ভব। ইন্টারনেট থেকেই জানা যায় তাঁদের অবস্থান। ভৌগোলিক এলাকা চিহ্নিত করা হয় সেই অনুযায়ী। আমেরিকার ক্ষেত্রে যা ছিল মিশিগান, উইসকনসিন, পেনসিলভেনিয়া, ফ্লরিডার মতো প্রদেশ। প্রত্যেককে চিহ্নিত করে তাঁর আবেগ, অনুভূতি অনুযায়ী টানা প্রচার চালানো হয়। ফলও মেলে। 

কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা পর্ব নিয়ে তৈরি নেটফ্লিক্সের তথ্যচিত্র ‘দ্য গ্রেট হ্যাক’-এ ফেসবুকের গোড়ার দিকের এক বিনিয়োগকারী রজার ম্যাকনামিকে বলতে শোনা যায়, ‘‘মানুষের মনোযোগের উপর একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করতে ফেসবুকের নকশা করা হয়েছে। ভয় আর রাগ, এই দু’টো মানবপ্রবৃত্তিকে নিশানা করলে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পাওয়া যায়। তাই প্রত্যেক ব্যবহারকারীর এই দুই অনুভূতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলে।’’

আমেরিকার ওই ভোটের পর কয়েক বছর কেটেছে। ফেসবুকেও এখন অনুভূতি প্রকাশের হরেক সুযোগ। তাই যন্ত্র-মেধার মাধ্যমে মানুষের মন পড়ার সুযোগ আরও বেড়েছে। সেই মন পড়েই যন্ত্রমেধা সমাজমাধ্যমে হাজির করে পছন্দসই উপাদান। ফেসবুকে পশুপাখির ভিডিয়ো কেউ টানা দেখলে ফেসবুকই তাঁর কাছে সাজিয়ে দেয় তেমন আরও অনেক ভিডিয়ো। গুগলের ইউটিউবেও পাওয়া যায় একই রকম ‘সাজেশন’। 

ব্যতিক্রম নয় আমাজ়নের কেনাকাটার অ্যাপও। তেমনই রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এক জন যা দেখতে, পড়তে ভালবাসেন, সমাজমাধ্যমে তাঁর কাছে বারবারই আসে সেই রকম খবরেরই বা ভুয়ো খবরের ‘ফিড’ যাতে মনে হয়, জগতে সেগুলোই একমাত্র সত্য।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen