‘তুলসী গাছ’ থেকে বিভাজনের রাজনীতি: হিন্দু ধর্মের পবিত্র প্রতীক যে ভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক অস্ত্র হয়ে উঠল

তুলসী যে শুধু হিন্দু ধর্মের পবিত্র প্রতীক তা নয়, বহু মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এই গাছকে ওষধিগুণ বা পরিবেশগত কারণে লালন করে থাকেন

July 4, 2025 | 2 min read
Published by: Drishti Bhongi

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ৮:৫৬: ভারতীয় জনজীবনে তুলসী গাছের (Tulsi plant) রয়েছে গভীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। হিন্দু ধর্মে একে লক্ষ্মীর রূপ হিসেবে পুজো করা হয়, যা ঘরোয়া শান্তি, পবিত্রতা ও শুভ শক্তির প্রতীক। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই পবিত্র গাছকেই এক অন্যরকম বিতর্কের কেন্দ্রে দাঁড় করানো হয়েছে – এবার তা ধর্মীয় বিভাজনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে বিজেপির (BJP) রাজনীতিতে।

তুলসী গাছ, হিন্দু ধর্মে তাৎপর্য কী?

তুলসী গাছকে হিন্দু ধর্মে দেবী তুলসীর প্রতীক হিসেবে মানা হয়। তুলসী বিবাহ, কার্তিক মাসে তুলসী পুজো ও প্রতিদিনকার সন্ধ্যারতিতে এই গাছ পূজিত হয়। বিশ্বাস করা হয়, তুলসীর উপস্থিতি বাড়িতে পবিত্রতা, সুস্থতা ও ঐশ্বর্য আনে। একে শুধু ধর্মীয় উপাচার নয়, জীববৈচিত্র্য ও আয়ুর্বেদিক (Ayurvedic) দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়।

মহেশতলার অশান্তি ও ‘তুলসী গাছ বিতর্ক’

২০২৫ সালের জুন মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলায় এক উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে (communal riot) জড়িয়ে পড়ে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় একটি স্থানীয় গোষ্ঠীর অভিযোগে, যেখানে তারা দাবি করে যে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের লোকজন একটি স্থানে তুলসী গাছ বসানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

সেই মুহূর্তে বিজেপির স্থানীয় নেতারা এই বিষয়টিকে “হিন্দু অধিকার” এবং “ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর আঘাত” বলে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে। তারা প্রচার চালায় যে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা হিন্দুদের নিজস্ব ধর্মাচরণের ওপর বাধা দিচ্ছে, এবং এই ঘটনাকে সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন মিছিলে “হিন্দু নিপীড়নের প্রতীক” হিসেবে তুলে ধরা হয়।

বিজেপির কৌশল এখানে ছিল স্পষ্ট: একটি ঘরোয়া ধর্মীয় উপাদানকে সাধারণ মানুষের আবেগের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরি করা। তারা বারবার তুলসী গাছ বসানোর অধিকারকে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন হিসেবে তুলে ধরতে থাকে।

পাশাপাশি, বিজেপি নেতারা মহেশতলার ঘটনাকে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা বলে আক্রমণ করে, এবং বার্তা দেয় যে তৃণমূল কংগ্রেস মুসলিম তোষণের রাজনীতি করছে। একাধিক জায়গায় “তুলসী সম্মান যাত্রা” ও “হিন্দু অধিকার যাত্রা”-র মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়।

তুলসী, ধর্ম ও রাজনৈতিক বিভাজন

এই ঘটনা আরও একবার প্রমাণ করল কীভাবে এক পবিত্র, নিরীহ গাছকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করা যায়। বিজেপির মতাদর্শগত রাজনীতি, যেখানে প্রতিটি ধর্মীয় প্রতীককে একটি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, সেখানে তুলসীও ছাড় পায়নি।

তুলসী যে শুধু হিন্দু ধর্মের পবিত্র প্রতীক তা নয়, বহু মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এই গাছকে ওষধিগুণ বা পরিবেশগত কারণে লালন করে থাকেন। কিন্তু বিজেপি একটি সামান্য ধর্মাচারকে একটি “আমরা বনাম ওরা” ফ্রেমে ফেলেই সেই সহাবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।

তুলসী গাছ যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সংস্কৃতিতে সহিষ্ণুতা, শান্তি ও পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু আজ তা একটি বিভাজনমূলক রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যখন ধর্মীয় প্রতীকগুলোকে রাজনৈতিক অজুহাতে ব্যবহার করতে শুরু করে, তখন প্রশ্ন ওঠে – পবিত্রতা ও বিশ্বাসের সীমারেখা কোথায়?

এই পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক শক্তির উচিত ধর্মীয় প্রতীককে রাজনৈতিক প্ররোচনার হাত থেকে বাঁচানো, যাতে তুলসী তার নিজস্ব ঐতিহ্যে থেকে যায় – শান্তি ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে, বিভেদের নয়।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen