‘SIR’ মানে ‘Silent Invisible Rigging’, বিজেপি ও কমিশনকে নিশানা অভিষেকের
তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “মানুষ নয়, কুকুরের নামেও রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে, অথচ প্রকৃত ভোটারদের বাদ দেওয়া হচ্ছে।

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৮:৪২: গতকাল মঙ্গলবার সংসদে অপারেশন সিঁদুর, SIR নিয়ে মোদীর বিবৃতির পর, বুধবার এনিয়ে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ শানালেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি অভিযোগ করেন, ‘SIR’ স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন-প্রক্রিয়া আসলে ‘Silent Invisible Rigging’-এর মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা।
তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “মানুষ নয়, কুকুরের নামেও রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে, অথচ প্রকৃত ভোটারদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন এটা শুরু করেছে বিজেপির পক্ষে, যারা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রকৃতভাবে সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে সে সমস্ত দেশের নাগরিকের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চাইছে নির্বাচন কমিশন।”
পহেলগাঁও হামলা প্রসঙ্গে তিন বলেন, “যারা নোটবন্দি করেছিল, যারা এনআরসি লাগু করতে চেয়েছিল, যারা দেশকে শেষ করে দিয়েছে, তারা আজ ইন্দিরা গান্ধী ও নেহরুকে দোষারোপ করছে! পহেলগাঁও হামলার জন্য দায়ী কে? ওরা বাংলা সম্পর্কে অপপ্রচার করে বলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশিদের ঢুকতে সাহায্য করছেন। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীর সীমান্তের দায়িত্ব কার? জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ কাদের অধীনে? সেই চার জঙ্গি ঢুকল কীভাবে? আর তারাই বড় বড় ভাষণ দেয়! অনুপ্রবেশকারীরা নাকি বাংলা দিয়ে ঢুকেছে, কিন্তু কাদের ব্যর্থতায়?”
মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশের পরেই ভারত অপারেশন সিঁদুর বন্ধ করা নিয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন অভিষেক। তাঁর অভিযোগ, “ভারতের কী করবে, সেটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঠিক করবেন কেন? ২০১৪-র আগে এই নরেন্দ্র মোদীই বলতেন, ‘রিমোট কন্ট্রোল সরকার’, বলতেন মনমোহন সিং ১০, জনপথ থেকে পরিচালিত হন। অন্তত সেই সময় রিমোট কন্ট্রোল দিল্লিতেই ছিল। এখন তো রিমোট কন্ট্রোল ওয়াশিংটনে! আমেরিকার প্রেসিডেন্টই কি আজ ভারতকে পরিচালনা করছেন? গতকালও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বললেন, উনিই যুদ্ধ থামিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী—কেউই তো বলেননি যে, তাঁরা ট্রাম্পের কথার বিরোধিতা করেন। লিখিতভাবে অন্তত বলতে পারতেন!”
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়ে বিস্ফোরক অভিষেক। তিনি ভারতের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে বলেন, “যদি আমাদের আধা সামরিক বাহিনী, সেনা, নৌসেনা, এবং বায়ুসেনাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হত, তাহলে আজ পাক-অধিকৃত কাশ্মীর আমাদের দখলে থাকত। যদি সত্যিই স্বাধীনতা দেওয়া হত, তাহলে যুদ্ধ থামানো হল কেন? কারণ কি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট চাপ দিয়েছেন? তাহলে ভারতের মানুষের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষার কোনও দাম নেই? ডোনাল্ড ট্রাম্পই ঠিক করবেন ভারতের ভবিষ্যৎ? এভাবে তো দেশ চলতে পারে না।”
তাঁর দাবি, এই বিশেষ তালিকা পর্যালোচনার নামে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে। “যেভাবে (নির্বাচন কমিশন) পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। আমি মনে করি এরা বিগত দিনেও দেখেছে বাংলায় করে কোনও লাভ হয়নি। বিহারে করেছে। আমার বিশ্বাস বিহারের মানুষ জবাব দেবে। যেভাবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। আমি মনে করি এরা বিগত দিনেও দেখেছে বাংলায় করে কোনও লাভ হয়নি। বিহারে করেছে। আমার বিশ্বাস বিহারের মানুষ জবাব দেবে।” বলেন অভিষেক।
এনআরসি (NRC) চালু করা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বলেন, “আধার কার্ড মানছে না, অথচ এমন ভুয়ো রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট মেনে নিচ্ছে। এটা কি ভুয়ো ভোটার ঢোকানোর জন্য? কার স্বার্থে এটা করা হচ্ছে? যদি সত্যিই কমিশনের উদ্দেশ্য থাকে, যাতে কোনও বৈধ ভারতীয় ভোটার বাদ না যায়, তাহলে এত তাড়াহুড়ো করে এভাবে শুরু করত না। ২০০৪-এর পর নাম তুললে, বাবা-মায়ের জন্ম শংসাপত্র চাওয়া হচ্ছে—একেবারে এনআরসি-র নিয়ম! এটা আসলে পিছনের দরজা দিয়ে এনআরসি চালু করার চেষ্টা।”
বিএসএফ (BSF) নিয়ে তাঁর অভিযোগ, “১৯৪৭-এর পর, দেশের সবচেয়ে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম অমিত শাহ। ওঁর আমলেই বহু জঙ্গি হামলা, অনুপ্রবেশ ঘটেছে—এগুলো সিআইএসএফ কিংবা বিএসএফের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। বাংলায় তো ওরাই বারবার বলেন কয়লা পাচার, গরু পাচার হয়। গরু তো ছোট প্রাণী নয়, যে কাঁটাতারের ফাঁক গলে পালাবে! বিএসএফ সাহায্য না করলে সীমান্ত পার হবে কীভাবে? সেই টাকার ভাগ কোথায় যায়?”
বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে অভিষেক বলেন, “ক’জন বিএসএফ জওয়ানকে সিবিআই বা ইডি ডেকেছে বা গ্রেপ্তার করেছে? পাঁচ বছর ধরে তদন্ত চলছে। কাউকে তলবও করা হয়নি আজ অবধি। কয়লা খনির নিরাপত্তায় থাকে সিআইএসএফ, তাদের কোনও কমান্ডার বা ডিরেক্টর জেনারেলকে তলব করা হয়নি। যদি বাংলাদেশ থেকে কেউ অনুপ্রবেশ করে, তার জন্য সবচেয়ে বড় দায় অমিত শাহর। ওঁর ইস্তফা দেওয়া উচিত। আগে ইস্তফা দিন, তারপর প্রশ্ন তুলুন।”
তিনি আরও জানান, এই বিষয়ে ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে এবং শুনানি পিছিয়ে অগস্টে গিয়েছে। বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা থাকলেও, ভোটাধিকার রক্ষায় বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। দিল্লিতে বৃহত্তর আন্দোলন হলে আমরা তা সংগঠিত করব। একজন মানুষেরও ভোটাধিকার কেড়ে নিতে দেওয়া হবে না, বলে মন্তব্য করেন তৃণমূল নেতা।
আসন্ন ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী তৃণমূল। অভিষেকের দাবি, ২০২১, ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোট বা ২০২৪-এর তুলনায় ২০২৬-এ আরও ভাল ফল করবে তৃণমূল। মানুষের আস্থা, ভালোবাসা এবং আশীর্বাদ দলের সঙ্গে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “২০২১ থেকে টাকা আটকে দেওয়া শুরু করেছে, এখন ভোটাধিকারও আটকে দিতে চাইছে। কারণ ওরা জানে, মানুষ ভোট দিতে পারলে বিজেপির বিপক্ষে রায় দেবে। কিন্তু মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। ”
পরিশেষে অভিষেক নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, “নির্বাচন কমিশন নিজে কিছু বলছে না, কিন্তু বিজেপি বলছে—বাংলায় নাম বাদ যাবে! নির্বাচন কমিশন কি এর প্রতিবাদ করেছে? এখনও তো SIR-এর কাজ শুরুই হয়নি, তার আগেই বিজেপি নেতারা বলে দিচ্ছে—বাংলায় ২ কোটি নাম বাদ যাবে। এই নিয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। বিরোধীরা কিছু বললেই ওরা বলে কমিশনের মানহানি হচ্ছে। কিন্তু বিজেপি প্রকাশ্যে বলছে ২ কোটি নাম বাদ যাবে—তাতেও নির্বাচন কমিশনের টুঁ শব্দ নেই! যদি সত্যিই সাহস থাকে, ২ কোটি দূরের কথা, দুটো নাম কেটে দেখাক, আমরাই ওদের বুঝিয়ে দেব তখন! বাংলায় ওরা যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। এটাই বাংলার সঙ্গে অন্য রাজ্যের পার্থক্য। যারা বলছে ২ কোটি, আমি বলছি—আগে দুটো নাম কেটে দেখাও!”
কমিশনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সিইও-র নেতৃত্বে জেলা নির্বাচনী আধিকারিক বা জেলাশাসক (ডিইও), অতিরিক্ত জেলাশাসক, ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার, অতিরিক্ত ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার এবং বুথ লেভেল অফিসারেরা (বিএলও) একত্রে ভোটার তালিকায় নাম থাকা প্রত্যেকের বাড়িতে সমীক্ষার কাজটি করবেন। তাতে একটি ফর্ম ভরে প্রয়োজনীয় তথ্য দাখিল করতে হবে এক-এক জনকে। তা যাচাই হবে।
তবে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি প্রকাশিত এসআইআর তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিদের অতিরিক্ত নথি দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। আবার যাঁদের অভিভাবকের নাম সেই তালিকায় রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও সমস্যা নেই। তবে সেই তালিকায় যাঁদের নাম নেই, নতুন ভোটার বা অন্য রাজ্য থেকে চলে আসা কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে পৃথক ফর্ম এবং নথি দাখিল করতে হবে। ওই সূত্র জানাচ্ছে ২০০২-এর তালিকায় যাঁদের নাম থাকবে না, তাঁদেরই পারিবারিক এবং এ দেশের নাগরিকত্বের সূত্র বুঝতে নথি যাচাই হবে।
উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা না হলেও বঙ্গে SIR-র প্রস্তুতি চলছে। যেকোনও মুহূর্তে বিজ্ঞপ্তি জারি হতে পারে। এর যৌক্তিকতা নিয়ে মামলা চলছে দেশের শীর্ষ আদালতে। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় SIR-কে বিজেপি ও নির্বাচন কমিশনের যৌথ ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখছেন। বিহারের বিরোধী দলনেতাও SIR-র প্রতিবাদে ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছেন। তৃণমূল দিল্লির দরবারে SIR বিরোধী আন্দোলনকে পৌঁছে দিতে চাইছে। লাগাতার প্রতিবাদে সরব হচ্ছে দলের সাংসদেরা।