নারীরও কামনা থাকে, কুসুম তা লুকায় না: পর্দার ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ নিয়ে জয়ার বিশ্লেষণ
কুসুমের ভূমিকায় জয়া আহসান। কুমুদ, সেনদিদি এবং যাদবের চরিত্রে রয়েছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনন্যা চট্টোপাধ্যায় এবং ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়।

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ২০.২৯: গ্রামের টানে শহুরে মন! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ এবার রূপ পেল সেলুলয়েডে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ, ১ আগস্ট ২০২৫, প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবি। ভারতবর্ষ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাস সমাজবাস্তবতা, মানসিক দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক উত্তালতার চিত্র হয়ে উঠেছিল বাংলার পাঠকের কাছে। পরিচালক সেই পাঠক-অভিজ্ঞতাকেই আধুনিক ভাষায় রূপ দিতে চেয়েছেন চলচ্চিত্রে।
ছবির কেন্দ্রে রয়েছেন শশী, একজন শহুরে ডাক্তার, যিনি একঘেয়েমি, স্মৃতিচারণ এবং আত্মসংকটের টানে ফিরে যান নিজের গ্রামে। সেই ভ্রমণ, যা প্রাথমিক ভাবে স্বল্পমেয়াদি বলে মনে হয়েছিল, ধীরে ধীরে পরিণত হয় দীর্ঘ বসবাসে। গ্রামীণ পরিসরে তাঁর আত্মবিশ্লেষণ, দায়বদ্ধতা, কামনা ও ক্লেশের গল্পই গড়ে তোলে এই চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট।
পরিচালক উপন্যাসের সময়কাল সামান্য এগিয়ে এনে ছবিটিকে স্থাপন করেছেন স্বাধীনতার ঠিক পূর্ববর্তী ভারতবর্ষে। মূল প্লট এবং চরিত্রের আবহ অপরিবর্তিত থাকলেও, ছবির ভাষা এবং আবেগ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়েছে চলচ্চিত্রের নিজস্ব গদ্য। চরিত্রদের মধ্যকার সম্পর্ক, সংঘর্ষ এবং নিঃশব্দ যন্ত্রণা নির্মাতা তুলে ধরেছেন মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভঙ্গিতে।
শশীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবির চট্টোপাধ্যায়। কুসুমের ভূমিকায় জয়া আহসান। কুমুদ, সেনদিদি এবং যাদবের চরিত্রে রয়েছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনন্যা চট্টোপাধ্যায় এবং ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। জয়া বলেন, “কুসুম ২৩ বছরের এক তরুণী, যে কিনা রহস্যময় একটি চরিত্র। কুসুমের চরিত্রে আছে খামখেয়ালিপনা এবং খাপছাড়া একটা স্বভাব।” তিনি আরও বলেন,
“সবসময় নারীকেই কামনার বস্তু হিসেবে দেখানো হয়েছে—কিন্তু কুসুমের নিজস্ব কামনা ও বাসনা আছে, যা সে লুকায় না। কুসুম একটি খোলা বইয়ের মতো—মন, শরীর ও আত্মা একাকার।”
অন্যদিকে, আবিরের কথায়, “শশীর মধ্যে রয়েছে এক রকম সিদ্ধান্তহীনতা, যা বাংলার মধ্যবিত্ত মননে চিরকালীন। সেই দ্বিধা ও যন্ত্রণার ব্যাখ্যা দেওয়াই ছিল সবচেয়ে কঠিন।” পরমব্রত যোগ করেন, “শুধু একটি দৃশ্যের জন্য এই ছবিটি করতে রাজি হই, পালাগানের দৃশ্য। যাত্রার অংশ হওয়ার সেই লোভ আমি সামলাতে পারিনি।”
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে ছবির শুটিং শেষ হলেও মুক্তি বারবার পিছিয়ে যায় আর্থিক ও লজিস্টিক সমস্যায়। পরিচালকের নিজের কথায়, তিনি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে উপন্যাসের একটি লাইন, “হতাশ আর ভগ্নোদ্যম সেসব মানুষ পুতুলের যান্ত্রিক জীবনের অপরূপ কাহিনি” তাঁকে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করে।
চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। রোটারডাম চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৫-এ এটি Big Screen Competition বিভাগে নির্বাচিত হয়। সেখানেও প্রশংসিত হয়েছে গ্রামবাংলার মনস্তত্ত্ব ও সমাজবাস্তবতা নিয়ে পরিচালকের বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ছবিটি কেবল একটি উপন্যাসের অনুবাদ নয়, এটি এক যুগসন্ধিক্ষণের গল্প। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এই চলচ্চিত্রে প্রশ্নটা যেন ঘুরে ফিরে আসে, শহর না গ্রাম, স্বপ্ন না বাস্তব, ইচ্ছা না কর্তব্য, আমরা আসলে কী চাই?