নীলরতন সরকার – রোগীদের ধন্বন্তরী
১৮৬১, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের সাল। ২৫ বৈশাখের ঠিক সাড়ে চার মাস পরে জন্ম নীলরতনের। মধুর সমাপতনে পরবর্তীতে দু’জন হবেন পরম বন্ধু। ডায়মন্ড হারবারের নেত্রা গ্রামে ১৮৬১ সালের ১ অক্টোবর জন্মান নীলরতন। বাবা নন্দলাল সরকার আর মা থাকোমণি দেবী। তখন নীলরতনের বয়স সাত। ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে ভিটেমাটি ধ্বংস হল। পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে নন্দলাল উঠলেন শ্বশুরবাড়ি জয়নগরে। এরও সাত বছর পরে গুরুতর অসুস্থ থাকোমণি দেবী টাকার অভাবে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। চোখের সামনে মাকে ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে দেখে রোখ চেপে গেল ১৪ বছরের ছেলের। ডাক্তার তাকে হতেই হবে!
১৮৭৬ সালে জয়নগর হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করলেন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতায় এলেন নন্দলাল সরকার। নীলরতন ভর্তি হলেন শিয়ালদহের ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে (পরবর্তীতে এনআরএস)। বাড়িতে অভাব। সংসার চালাতে শিক্ষকতা শুরু করলেন বড়দা অবিনাশচন্দ্র। আর এক ভাই যোগীন্দ্রনাথ সরকার। পরবর্তী কালে যিনি ‘হাসিখুশি’ লিখেছিলেন। নীলরতনও উপার্জনের জন্য শিক্ষকতা, পরীক্ষার হলে পাহারা, জনগণনার কাজ করেছেন। তার মধ্যেই স্বনামধন্য চিকিৎসক তামিজ খানের প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলেন।
১৮৮১ সালে এলএমপি পাশ করলেন ভাল ভাবে। কিন্তু মনে অশান্তি। সেই ব্রিটিশ আমলে মেডিক্যাল শিক্ষায় ছিল দ্বৈত ব্যবস্থা। নেটিভ ছাত্রদের জন্য বাংলায় পঠনপাঠন হত। কিন্তু মেডিক্যালের বই সব ইংরেজিতে। তার তর্জমা ঠিকঠাক হত না। অনেক কিছু অজানা, অধরা থাকত। নীলরতনের মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। বাংলা ভাষায় ডাক্তারি পাশ করা নেটিভ ডাক্তারদের জন্য নির্ধারিত ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের চাকরি। তা করতে অপমানিত বোধ করলেন। পেশা বদলে শ্রীরামপুরের কাছে চাতরা হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক হয়ে চলে গেলেন।
ক্রমে মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে ১৮৮৩ সালে এলএ এবং ১৮৮৫তে বিএ পাশ করেন। গ্রে স্ট্রিটে সরোজিনী নাইডুর বাবা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় স্থাপিত অঘোরনাথ বিদ্যালয়ে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন। সেই সময়ে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্তকে। যিনি পরবর্তীতে পরিচিত হবেন ‘বিবেকানন্দ’ নামে।
১৮৯০ সালে নীলরতন যখন এমডি হচ্ছেন, তার আগে মাত্র ছ’জন এমডি পরীক্ষায় পাশ করেছেন। তাঁরা হলেন চন্দ্রকুমার দে, মহেন্দ্রলাল সরকার, জগবন্ধু বসু, আরডব্লিউ কার্টার, ভগবৎচন্দ্র রুদ্র এবং রামপ্রসাদ বাগচী। পাশ করার পরে ৬১ নম্বর হ্যারিসন রোডে (এখন মহাত্মা গাঁধী রোড) নিজের বাড়িতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করলেন। তার পরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি নীলরতনকে। পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে ভারতবর্ষের চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি ছিলেন উৎকর্ষ এবং খ্যাতির শিখরে।
রোগীদের কাছে তিনি ছিলেন জীবন্ত ঈশ্বর। দু’হাতে বিপুল রোজগার করেছেন আবার স্বদেশি শিল্প গড়তে গিয়ে এক সময়ে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তাতে বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘‘কলকাতায় ২০ টাকায় ভাড়ার ঘর পাওয়া যায়। তাতেই আমার চলে যাবে।’’ কখনও গরিব রোগীকে অর্থাভাবে চিকিৎসায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁর দরজা থেকে ফিরতে হয়নি। পথ থেকে তুলে এনে বহু মানুষকে নিজের ৭ নম্বর শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে রেখে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছেন।
শিক্ষকতার জগতে গেলেও নীলরতনের ভাগ্যে ছিল ডাক্তারি। ক্যাম্পবেল স্কুলের তৎকালীন সুপার ম্যাকেঞ্জি সাহেবের সুপারিশে ১৮৮৫ সালে ভর্তি হয়ে গেলেন বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে (যা এখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ)। তাঁর রেজ়াল্ট এত ভাল ছিল যে, পাঁচ বছরের ডাক্তারি কোর্সে সরাসরি তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হলেন। মর্যাদাপূর্ণ ‘গুড ইভ’ বৃত্তি পেলেন পড়াশোনায় উৎকর্ষের জন্য। ১৮৮৮তে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবি পাশ করলেন। মেয়ো হাসপাতালে হাউস সার্জনশিপ করতে করতে এমএ এবং এমডি-র প্রস্তুতি শুরু করলেন। ১৮৮৯ সালে একই সঙ্গে দু’টি পরীক্ষাতেই সসম্মান উত্তীর্ণ হলেন।
সে যুগে সাহেব ডাক্তারদের প্রবল প্রতাপে দেশীয় চিকিৎসকেরা কুঁকড়ে থাকতেন। দেশীয় চিকিৎসকদের ভিজ়িট ছিল ২ টাকা, ৪ টাকা, ৮ টাকার মধ্যে। অন্য দিকে সাহেব ডাক্তারেরা ১৬ টাকা, ৩২ টাকা, ৬৪ টাকা ভিজ়িট নিতেন। কিন্তু প্রবল স্বদেশি জাত্যাভিমান দাপুটে বাঙালি চিকিৎসকের রক্তে। চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দিলেন তিনিই। দেশীয় চিকিৎসক হয়েও প্রথম ১৬ টাকা ভিজ়িটে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করলেন। ব্রিটিশদের চোখ কপালে উঠল। সেই ভিজ়িট ক্রমে ৬৪ টাকায় পৌঁছেছিল! তাঁকে অনুসরণ করে অন্তরঙ্গ বন্ধু সার্জন সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারীও চিকিৎসক বাবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে ১৬ টাকা ভিজ়িট নিতে শুরু করেন।
ডানীলরতন রোগী দেখার সময়ে রোগীর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ধীর-স্থির ও বিনয়ী ব্যবহার করতেন। বিরক্ত না হয়ে রোগীর বিস্তারিত ইতিহাস নেওয়া ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তাঁকে পরীক্ষা করা আজও চিকিৎসা শাস্ত্রের পড়ুয়াদের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।