সংসদে মোদীর ‘ঔদ্ধত্য’! ঋষি বঙ্কিমকে ‘বঙ্কিমদা’ সম্বোধন, তীব্র প্রতিবাদ তৃণমূলের

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৫:১৫: ফের প্রকাশ্যে এল বিজেপির তথাকথিত ‘বাঙালি প্রীতি’-র আসল রূপ। খোদ সংসদের গরিমা ক্ষুণ্ণ করে রাষ্ট্রগীতের রচয়িতা সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে (Bankim Chandra Chattopadhyay) ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi)। সোমবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের জবাবি বক্তৃতায় মোদীর এই অবমাননাকর সম্বোধনের তীব্র প্রতিবাদ জানালেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় (Sougata Roy)। প্রতিবাদের মুখে পড়ে সম্বোধন বদলাতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু নিজের ভুলের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইলেন না। উল্টে বজায় রাখলেন নিজের স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্য।
নির্বাচন এলেই প্রধানমন্ত্রীকে বাংলা ও বাঙালির প্রতি দরদ উথলে উঠতে দেখা যায়। কখনও টেলিপ্রম্পটার দেখে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বক্তৃতা, কখনও আবার মা কালী বা মা দুর্গার নাম নিয়ে বাঙালির ভাবাবেগ ছোঁয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ, এসবই যে নিছক নাটক, তা বারবার প্রমাণ করে দেন তিনি নিজেই। সোমবার সংসদে দাঁড়িয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বারবার ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, বাংলার মনীষীদের প্রতি তাঁর বা তাঁর দলের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই।
এদিন সংসদে নিজের বক্তব্যের সময় একবার নয়, পরপর চারবার বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করেন মোদী। প্রথমে অনেকে ভেবেছিলেন, হয়তো বলার ঝোঁকে ভুলবশত এমনটা বলে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু দেখা যায়, বিষয়টি ইচ্ছাকৃত। বারবার এই অসম্মানজনক সম্বোধন কানে বাজতেই গর্জে ওঠেন বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সাহিত্যসম্রাটকে এভাবে ‘দা’ সম্বোধন করতে পারেন না। সম্মানের সঙ্গে অন্তত ‘বঙ্কিমবাবু’ বলা উচিত।
সৌগত রায়ের এই প্রতিবাদের পর অবশ্য নিজের সম্বোধন বদলান নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু সেখানেও ছিল ঔদ্ধত্যের ছাপ। নিজের ভুল স্বীকার বা ক্ষমা চাওয়ার বদলে তিনি হেসে ওঠেন। এরপর বলেন, সাংসদের অনুভূতির প্রতি তিনি সংবেদনশীল, তাই তিনি সম্বোধন পরিবর্তন করছেন। অর্থাৎ তিনি যে ভুল করেছেন, তা স্বীকার না করে বিষয়টি ‘অনুভূতির খাতিরে’ করছেন বলে বুঝিয়ে দেন। এরপর তিনি ‘বঙ্কিমবাবু’ উচ্চারণ করেন।
তৃণমূলের দাবি, মুখে বাংলা দরদী সাজলেও, আদতে যে নরেন্দ্র মোদী ঘোর বাংলা-বিরোধী, ‘বঙ্কিমদা’ কাণ্ডে তা ফের প্রমাণিত হল।
লোকসভায় ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান এবং বিতর্ক চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠল জাতীয় রাজনীতি। সংসদে দাঁড়িয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী ‘বঙ্কিম দা’ বলে সম্বোধন করায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাল তৃণমূল কংগ্রেস। শাসকদলের অভিযোগ, এই সম্বোধন বাংলার সংস্কৃতির পরিপন্থী এবং মণীষীদের প্রতি বিজেপির অজ্ঞতার প্রমাণ।
তৃণমূল কংগ্রেস তাদের সামাজিক মাধ্যমের পেজে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করে লেখে, “বিজেপি যে কতটা বাংলা-বিরোধী, সেটার প্রমাণ হাতে-নাতে দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলার সংস্কৃতির মেরুদণ্ড, তিনি বিজেপির ড্যামেজ কন্ট্রোলের উপকরণ নন। তাঁকে ‘বঙ্কিম দা’ বলাটা শ্রদ্ধার ভাষা নয়, বরং সাংস্কৃতিক অজ্ঞতার প্রমাণ।” দলের তরফে আরও অভিযোগ করা হয় যে, বিজেপি নেতারা বারবার বাংলার ইতিহাস ও মণীষীদের অপমান করেছেন। অতীতে জে.পি. নাড্ডা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন, সুকান্ত মজুমদার স্বামী বিবেকানন্দকে ‘অজ্ঞ বামপন্থী প্রোডাক্ট’ বলেছিলেন এবং অমিত শাহের মিছিলে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল। তৃণমূলের দাবি, বিজেপি আদতে বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ ‘বহিরাগত’।
এই প্রসঙ্গে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, “মহান সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে সম্বোধন করেছেন, তা পীড়াদায়ক। আমি প্রধানমন্ত্রীকে নরেন্দ্র মোদী ‘দা’ বলতে পারি না, আমার সংস্কৃতি এটা অনুমোদন করে না।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, বিজেপি ও তাদের নেতারা মনে-প্রাণে বাঙালি-বিদ্বেষী, কিন্তু ভারতের ইতিহাসে বাঙালিদের অবদান থাকায় বাধ্য হয়ে তাঁদের নেতাজি বা রবীন্দ্রনাথকে সহ্য করতে হয়।
সাংসদ মহুয়া মৈত্র ‘বন্দে মাতরম’ বিতর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিজেপিকে একহাত নেন। তিনি বলেন, “১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে ‘বন্দে মাতরম’-এর প্রথম দুটি স্তবক গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুকে। আজ নির্বাচনের আগে বিজেপি নতুন করে এই বিতর্ক উসকে দিচ্ছে। কিন্তু যাদের শাসিত রাজ্যে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ হয়, তাদের মুখে এই দেশপ্রেম মানায় না।”
অন্যদিকে, তৃণমূল সাংসদ সাগরিকা ঘোষ এবং কাকলি ঘোষ দস্তিদারও বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। সাগরিকা ঘোষ উল্লেখ করেন, শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘বঙ্কিম দাস’ চ্যাটার্জি বলে ভুল করেছেন, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। কাকলি ঘোষ দস্তিদার সাভারকরের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “বিজেপির পূর্বসূরীরা যখন মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, তখন বাংলার শত শত বিপ্লবী দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। বাংলার মানুষ ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের এই অপমান মেনে নেবে না।”
রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বাংলায় এসে মেকি প্রেম দেখিয়ে মণীষীদের গলায় মালা পরানো আর দিল্লিতে দাঁড়িয়ে তাঁদের হেয় করা- এই দ্বিচারিতা মানুষ ধরে ফেলেছে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্রকে এই অপমান, সবকিছুর জবাব মানুষ গণতান্ত্রিক উপায়েই দেবে।”
সব মিলিয়ে, ২৬ শে বাংলায় বিধানসভা ভোটের আগে ‘বন্দে মাতরম’ ও বঙ্কিমচন্দ্রকে কেন্দ্র করে বাংলা বনাম দিল্লির সংঘাত ফের চরমে উঠল।