কংক্রিট নয়, পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে মাটির বাড়িই! যাদবপুরের গবেষণায় নয়া তথ্য
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১০:০০: আধুনিকতার ইঁদুর দৌড়ে মানুষ যখন মাটির ঘর ছেড়ে চোখ বন্ধ করে কংক্রিটের বহুতল বা পাকা বাড়ির দিকে ঝুঁকছে, ঠিক তখনই উল্টো পথে হাঁটার বার্তা দিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (JU) গবেষকরা। পরিবেশের স্বাস্থ্যের নিরিখে পাকা বাড়ির জৌলুস যে ফিকে এবং চিরাচরিত মাটির বাড়িই যে প্রকৃত ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’, তা পরিসংখ্যাল দিয়ে প্রমাণ করে দিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।
সম্প্রতি এই বিষয়ে একটি বিস্তারিত গবেষণা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সিনিয়র গবেষক অরিত্র মজুমদার। তাঁর সঙ্গে এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক অনুপম দেব সরকার ও কেএমডিএ-র প্রাক্তন মুখ্য বাস্তুকার (ইঞ্জিনিয়ার) কৌশিক দত্ত রায়। তাঁদের গবেষণাপত্রটি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকাশনা সংস্থা ‘স্প্রিঞ্জার নেচার’-এর ‘জার্নাল অব হাউসিং অ্যান্ড দ্য বিল্ট এনভায়রনমেন্ট’-এ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত ‘নেট জিরো ফিউচার ২০২৫’ আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও অরিত্রবাবু এই গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
*কী বলছে পরিসংখ্যান?*
পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। গবেষণার ফলাফল রীতিমতো চমকপ্রদ:
*কার্বন নিঃসরণ:* একটি কংক্রিটের বাড়ি তার সম্পূর্ণ জীবনচক্রে (তৈরি থেকে ভাঙা পর্যন্ত) প্রায় ৬৪,৮৭৭ কেজি কার্বন নিঃসরণ করে। সেখানে একটি মাটির বাড়ির ক্ষেত্রে এই পরিমাণ মাত্র ৩০,৯৪৫ কেজি। অর্থাৎ, মাটির বাড়িতে কার্বন নিঃসরণ ৫২.৩ শতাংশ কম।
*জলের ব্যবহার:* জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে দাঁড়িয়ে জলের অপচয় রোধ অত্যন্ত জরুরি। দেখা গিয়েছে, পাকা বাড়ি তৈরিতে ৪৮,৫৫৩ এম কিউব জল লাগে, যেখানে মাটির বাড়িতে লাগে মাত্র ১০,৬৮৪ এম কিউব। অর্থাৎ মাটির বাড়িতে প্রায় ৭৮ শতাংশ (৭৭.৯৯%) কম জল খরচ হয়।
*প্রাকৃতিক সম্পদ:* পাকা বাড়ির তুলনায় মাটির বাড়িতে প্রাকৃতিক উপাদানের খরচও প্রায় ৫০.২৬ শতাংশ কম।
গবেষক অরিত্র মজুমদার জানান, এই গবেষণায় ‘লাইফ সাইকেল অ্যাসেসমেন্ট’ (Life Cycle Assessment) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ একটি বাড়ি তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে, তার ব্যবহারকাল এবং অবশেষে বাড়িটি ভেঙে ফেলার সময় পর্যন্ত-মোট কত পরিমাণ শক্তি, জল ও উপকরণের ব্যবহার হচ্ছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব করা হয়েছে।
অরিত্রবাবুর কথায়, “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল লৌকিক স্থাপত্য বা মাটির বাড়ির সঙ্গে কম খরচের কংক্রিটের বাড়ির তুলনা করা। দেখা গেল, গ্রামের চিরাচরিত কাদামাটি, খড়, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর শুধু আরামদায়কই নয়, পরিবেশের জন্যও অনেক বেশি নিরাপদ। সিমেন্ট, রড ও বালির অত্যাধিক ব্যবহার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই গবেষণা আগামী দিনের আবাসন নীতিতে বড়সড় বদল আনতে পারে। গবেষকদের পরামর্শ, যদি ঐতিহ্যবাহী নির্মাণের জ্ঞানকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মিশিয়ে কাজে লাগানো যায়, তবে আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বাসস্থান তৈরি সম্ভব। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের নিরিখে সংবেদনশীল উপকূলীয় এলাকাগুলির জন্য এই মডেল ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠতে পারে।