আজও ইতিহাস বয়ে চলছে শোভাবাজার রাজবাড়ি
বড় তরফের কাঠামো পুজো হয় রথের দিন। দেবীর যে পা সিংহের উপরে থাকে, তার বাঁশটি পুজো করে কুমোরকে দিয়ে দেওয়া হয় প্রতিমা নির্মাণের জন্য। ১৭৫৭ সালে প্রথম বছর পুজোর সময়ে যে কাঠামো তৈরি হয়েছিল সেই কাঠামোর উপরেই আজও মূর্তি গড়া হয় শোভাবাজার রাজবাড়ির এই দুর্গাপ্রতিমার। রাজবাড়ির ছোটতরফের কাঠামো পুজো হয় উল্টো রথের দিন। মহালয়ার দিন দেবীর চক্ষুদান করা হয়।
কৃষ্ণা নবমীর দিন ঘট স্থাপন করা হয়, হয় বোধনও। চণ্ডীপাঠও শুরু সে দিন থেকেই। এর পরে ষষ্ঠী পর্যন্ত টানা চলতে থাকে চণ্ডীপাঠ। সুরেলা মন্ত্রোচ্চারণে মথিত হয় গোটা বাড়ি। শুক্ল প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত দেবীকে দেওয়া হয় নানা প্রসাধনী- অঙ্গরাগ, কেশ সংস্কারের সামগ্রী, সুগন্ধী আতর, আলতা সিদুঁর,কাজল। বড়তরফের তৃতীয়ার দিন দেবীকে চৌকিতে তোলার পরে শুরু করা হয় সাজ। ষষ্ঠীর দিন নবপত্রিকাকে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয় স্নান করাতে। তাঁর মাথায় ধরা হয় ভেলভেট আর সোনার সুতোয় কারুকাজ করা ছাতা।
দুই তরফেই প্রতিমা একচালার। ডাকের সাজে দেবীকে সাজানোটা প্রথম থেকেই রীতি এ বাড়িতে। আগে জার্মানি থেকে অর্ডার দিয়ে ডাকের সাজ আনানো হত। সেই প্রথা বহুদিন আগে বন্ধ হওয়ার পরে কৃষ্ণনগরের শিল্পীরাই পরম যত্নে দেবীর সাজ বানিয়ে দেন। তবে দুই তরফেই প্রথম থেকেই পুজোর পোশাক হয় রাজস্থানী ঘরানার। বড় তরফের সিংহের গায়ের রং সাদা। মুখ ঘোড়ার মতো। ছোট তরফের সিংহের চেহারা কিন্তু আলাদা। মুখ অনেকটা সিংহির মতো, গায়ের রং রূপোলি। আগে বিদেশ থেকে রুপোর পাত এনে সিংহের গা মুড়ে দেওয়া হত প্রতিবছর। সেই পাত-সহই প্রতিমা বিসর্জন হত। এখন আর তা সম্ভব হয় না। তবে সিংহের গায়ের রং এখনও প্রথা মেনে রুপোলিই রাখা হয়। ষষ্ঠীর দিন দেবীকে গয়না পরান পরিবারের সদস্যরা। রুপোর অস্ত্রশস্ত্র ওঠে দেবীর হাতে।
আগে বড়তরফ থেকে শোভাযাত্রা বেরতো ‘শ্রী’ আনতে। পাল্কিতে বসিয়ে প্রধান পুরোহিতের বাড়িতে গড়া ‘শ্রী’ আনা হত ঠাকুরদালানে। সঙ্গে থাকত বল্লমধারী পেয়াদা এবং বাজনদারের দল। এখনও ঢাকঢোল বাজিয়ে পুরোহিতের বাড়ি থেকে শ্রী আসে। ব্রাহ্মণ বাড়ি নয় বলে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না।বড় তরফে সপ্তমীর দিন দেবীকে ভোগ হিসেবে দেওয়াহয় ‘আগা’। বিরাট কাঁসার থালায়চুড়ো করে শুকনো চাল সাজিয়ে তার উপরে সাজিয়ে দেওয়া হয় মঠ গোটা পান ও সুপারি। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীতে তেত্রিশটি থালায় করে চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এছাড়াও দেবীকে দেওয়া হয় রাধাবল্লভী, সিঙ্গারা, খাস্তাকচুরি, জিলিপি, পদ্মনিমকি এবং রকমারি ফল। পুজোর আগে হালুইকর এসে ভিয়েন বসান। যাবতীয় মিষ্টি তৈরি হয় বাড়িতেই। রাতে দেবীকে দেওয়া হয় মাখন-মিছরির ভোগ।এই বাড়ির ছোট তরফে এক সময়ে বিশাল বিশাল থালায় ১ কিলো ওজনের সাদা রংয়ের মোতিচুর লাড্ডু ভোগে দেওয়া হত, তাতে থাকত গোলমরিচ আর এলাচ। বিশালাকার জিভেগজা,এক আঙুল সমান উঁচু জিলিপি-সব মিলিয়ে আকারে আয়তনে দেখার মতো ছিল সেকালের ভোগের আয়োজন।
সপ্তমী অষ্টমী এবং নবমীতে দেবীকে চেলীর শাড়ি দেওয়া হয়। বড়তরফে সন্ধি পুজোয় কখনও দেওয়া হয় চাঁপা ফুল রংয়ের শাড়ি, কখনও বা ভোরের আকাশের মতো নীল শাড়ি। পুজোর সময়ে বড় তরফের গৃহদেবতা রাধা-গোবিন্দজিউকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। একইভাবে ছোটতরফের গোপীনাথজিউকেও উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। আগে দুই বাড়ির সন্ধিপুজোর সূচনা হত কামান নির্ঘোষে। হোগলার বন, কাঁচা-পাকা বাড়ির বসতি, রাস্তাঘাট পেরিয়ে নিস্তব্ধ শহর জুড়ে দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত সে শব্দ। সারা শহরের মানুষ জানতেন অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তির জয় নিশ্চিত-কামান জানান দেয় সে কথাই। এখন আর সে প্রথা নেই। তবে ছোট তরফে আজও সন্ধি পুজোর আগে শূন্যে গুলি ছুঁড়ে পুজোর সূচনা করা হয়।
রাজবাড়ির বড় তরফে আগে পুজোর তিন দিন ছাগবলি দেওয়া হত। কিন্তু একবার বলির সময়ে হাঁড়িকাঠ থেকে পালিয়ে একটি পাঁঠা সোজা রাধাকান্তদেবের কাছে এসে আশ্রয় নেয়। আশ্রয়প্রার্থীকে আর মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে রাজি হননি রাধাকান্ত দেব। কিন্তু রক্ত ছাড়া যেহেতু শক্তির আরাধনা হয় না, তাই পণ্ডিতদের বিধানে তিনি নিজের আঙুল কেটে রক্ত দেন। এরপর থেকে পাঁঠার বদলে মাগুর মাছ বলি দেওয়া শুরু হয়। অষ্টমী-নবমীর দিন এ বাড়িতে চালকুমড়ো, আখ আর মাগুর মাছ বলি দেওয়া হয়। রাজবাড়ির ছোট তরফে অবশ্য সাবেক নিয়ম মেনে এখনও ছাগ বলি হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিন দিনে তিনটি। দেবী শ্ব্শুরবাড়ি চলে যাচ্ছেন, তাই নবমীর দিন দুই বাড়ি থেকেই দেবীকে সিধে দেওয়া হয়। এর মধ্যে থাকে চাল, ডাল, আনাজপাতি, মশলা, মানকচু, রুইমাছ, সৈন্ধব লবন, শাড়ি ও ধুতি।বাড়ির মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় যেমন কনকাঞ্জলি দেয়, এ বাড়ির দুর্গাও কৈলাশে ফেরার সময়ে কনকাঞ্জলি দেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুই তরফেই এই প্রথা প্রচলিত আছে। আগে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলারা আঁচল পেতে সেই কনকাঞ্জলি নিতেন। সোনা রূপোর মুদ্রা, চাল দেওয়া হত তাতে। সেই দিন আর নেই।এখন দেওয়া হয় টাকা-পয়সা আর চাল। দেবীর হয়ে পুরোহিত পিছন দিকে এগুলি ফেলেন। বাড়ির বড়রা প্রতিমার পিছনে দঁড়িয়ে সেগুলি গ্রহণ করেন। প্রতিমা বিসর্জন দিতে বাড়ি থেকে রওনা করার সময় তলোয়ার এবং ঘোড়া পূজা করা হয়। মনে করা হয় এই তলোয়ারই সারা বছর পরিবারকে রক্ষা করবে বিপদ-আপদ থেকে।
শোভাবাজার রাজবাড়ির বিসর্জন প্রথম দিন থেকেই এক জমজমাট ব্যাপার। দু’বাড়ির থেকে ৩২ থেকে ৪০জন বাহক দেবীকে বহন করে গঙ্গায় নিয়ে যায়। বাড়ির ঠাকুরদালানের উপরে রয়েছে অস্ত্রাগার। পলাশীর যুদ্ধের সময়কার বল্লম, তলোয়ার গদা এখনও রাখা আছে এখানে। আগে এগুলি নিয়ে বাড়ির লোকেরা বিসর্জনের সময়ে দেবীর সাথে যেতেন। বিসর্জনের পথের দু’দিকে হাতে হাত জড়িয়ে মানবশৃঙ্খল তৈরি করে ঘিরে দেওয়া হত পুরো রাস্তা। সত্তর দশকের কলকাতায় আগুনঝরা অশান্ত সময়ে অস্ত্র নিয়ে শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আগে নিয়ম মেনে দশমীতে নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়া হলেও এখন সেই প্রথাও বন্ধ। তার বদলে বেলুনে শোলার তৈরি নীলকণ্ঠ বসিয়ে উত্তর দিকে মুখ করে সেই বেলুন ছেড়ে দেয় বড় তরফ। আর মাটির নীলকন্ঠ পাখি তৈরি করে দেবীর সঙ্গেই সেগুলির পুজো করে ছোটতরফ। তারপর গঙ্গায় গিয়ে বিসর্জন দেয়। সেই সঙ্গেই বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে এবং পরে দুটি নীলকণ্ঠ পাখি আঁকা ফানুস ছাড়ে। এরপর মাঝগঙ্গায় জোড়া নৌকায় করে প্রতিমা নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়।
এতকাল ধরে পুজো শুরুর প্রথমদিন থেকে চলে আসা কিছু নিয়ম এতটুকু পাল্টায়নি দুই বাড়িই। কিন্তু এবার করোনার অভিঘাতে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। ছোটতরফের পুজোয় এবার বাইরের লোকের প্রবেশের অনুমতি নেই। বাড়ির লোকেদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিচয়পত্র। তাঁরাও সেটা দেখিয়েই শুধু প্রবেশ করতে পারবেন। বড় তরফের পুজোয় কোনও দিন বাড়ির সদর দরজা বন্ধ হয়নি।তাই এবারেও করা হচ্ছে না।তাই গেটের কাছে বসানো হবে স্যানিটাইজিং টানেল। এর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পরে থার্মাল চেকিং করা হবে দর্শনার্থীদের। মাস্ক পরে সামাজিক দূরত্ব মেনে তবেই ঢোকা যাবে পুজোয়। তবে বাড়ির লোক ছাড়া আর কেউই ঠাকুরদালানে উঠতে পারবেন না।