বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

কাজী নজরুল ইসলাম ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

May 26, 2023 | 4 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি:

মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান 

মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ ॥ 

এদেশের সাধারণ মানুষদের ওপরে ব্রিটিশদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে ও তৎপরবর্তীকালে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন বিপ্লবীরা। আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সেই আন্দোলনেরই একজন ‘তূর্য বাদক’ । তাঁর বিভিন্ন রচনায় বারে বারে উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’তেই পাওয়া গিয়েছিল একজন ধর্মনিরপেক্ষ সমন্বয়বাদী কবিকে। তিনি এ গ্রন্থে ‘মোহররম’ ‘কোরবানী’ ‘খেয়াপারের তরণী’ ‘শাত-ইল্-আরব’ ইত্যাদি মুসলিম প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গের কবিতার সঙ্গে সংযোজন করলেন হিন্দু দেবী ও উৎসব নিয়ে রচিত কবিতা ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’ ও ‘আগমনী’। আবার এ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হলো ‘প্রলয়োল্লাস’ ও ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা—যেসব কবিতায় হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ অসাধারণ দক্ষতায় সংস্থাপিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় ‘বিদ্রোহী’র মতো আর একটি কবিতাও লেখা হয়নি, যেখানে সব ধর্মের নানা অনুষঙ্গ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এতটা কুশলতার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। 

এ কারণেই বোধ হয়, ‘বিদ্রোহী’ যে পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়, সেই বিজলী পত্রিকার ওই সংখ্যার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়েছিল। একটি কবিতার জন্য কোনো পত্রিকার দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ—নজরুল-সমকালে এও আরেক অনন্য দৃষ্টান্ত। তৎকালীন পাঠক নজরুলের সর্বসংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়া অনিন্দ্যসুন্দর কবিতা ‘বিদ্রোহী’কে গ্রহণ করেছিল নিশ্চয়ই, তা না হলে এ যুগেও কয়টি পত্রিকার দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়? এ কাব্যগ্রন্থে আধুনিক তুরস্কের জনক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ককে নিয়ে নজরুল কবিতা লিখেছেন। যে সময় প্যান-ইসলামিজমে বেশির ভাগ মুসলমানের আগ্রহ, সে সময় তিনি ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা থেকে কবিতায় নায়ক করলেন কামাল পাশাকে। 

অগ্নিবীণায় প্রকাশিত সম্পূর্ণভাবে হিন্দু-ঐতিহ্য নিয়ে লেখা নজরুলের প্রথম কবিতা ‘আগমনী’। এই কবিতায় নজরুল যেভাবে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন, মনে হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চেয়েও এই ধ্বনির প্রতি আন্তরিকতা তাঁর বেশি। ধর্ম ও সম্প্রীতির ঊর্ধ্বে ‘মানুষ’ পরিচয়কেই মুখ্য করতে গিয়ে নজরুল সবাইকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন। হিন্দু বা মুসলিম অথবা অন্য কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে ‘মানুষ’ পরিচয়ই যে আমাদের কাছে প্রধান হওয়া উচিত, নজরুল তা বলেছেন।

তিনি যে সময় কবিতা লিখেছেন, সে সময় ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক ভেদ-রাজনীতি প্রকট হতে থাকে। প্রধান দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশদের বিভেদনীতির কারণে। প্রায়ই ভ্রাতৃঘাতী হয়ে ওঠে তারা। এসব দেখে কাজী নজরুল ইসলামের উচ্চারণ ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ : “অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, /কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ। /‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?/কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।” কবিতা থেকে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রচিত গানেও আন্তর্ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ’ আরেকটি গানে লিখেছেন : ‘হিন্দু-মুসলমান দুটি ভাই/ ভারতের দুই আঁখি-তারা/ এক বাগানে দুটি তরু/ দেবদারু আর কদম-চারা’ এ প্রসঙ্গে নজরুলের ইসলামী গান ও হিন্দুধর্ম সংশ্লিষ্ট গানগুলো বিবেচনায় আনা যেতে পারে। গ্রামোফোন কম্পানির প্রয়োজনে এবং নিজের অর্থ রোজগারের দরকারে নজরুল একসময় প্রচুর শ্যামাসংগীতসহ হিন্দুধর্মসংশ্লিষ্ট গান রচনা করেন। সে সূত্র ধরেই তিনি লেখেন ইসলামী গানও। দেখা যায়, এসব ইসলামী গান বা হিন্দুধর্মসংশ্লিষ্ট গানেও নজরুলের ধর্মীয় সমন্বয়চেতনা ব্যাপক। নজরুল ইসলাম যে শ্যামাসংগীত, ভজন, কীর্তনগুলো রচনা করেছেন, তা শুনলে বোঝা যায়, তাঁর কতটা আত্তীকৃত ছিল ভারতীয় দর্শন, বিশেষ করে  হিন্দুপুরাণ।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গদ্য রচনায় আন্তর্ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলেছেন অধিকতর স্পষ্ট করে। বিশেষ করে তাঁর রচিত প্রবন্ধ ও অভিভাষণে এই ভাবনা ব্যাপক ও সরাসরিভাবে প্রকাশিত। একটি অভিভাষণে তিনি বলেছেন, ‘কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’ এই সরল ও সরাসরি স্বীকারোক্তির পর নজরুলের সম্প্রীতিচেতনা পৃথকভাবে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন হয় না। 

তিনি মনে করেন, হিন্দু ও মুসলিম যদি পরস্পরকে ঈর্ষা ও ঘৃণা করতে থাকে, তাহলে ভারতের স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব। ইংরেজরা তাদের শিক্ষার চাকচিক্যে ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিমের নিজস্ব প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তিনি এ সম্পর্কে ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিমদের সজাগ করেছেন এক অভিভাষণে : ‘ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি—শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে—তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা মুসলমানেরা আমাদেরই প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনত দেখে আমাদের অশ্রদ্ধা করে।’ নজরুল কর্ম-সাগরে সব ধর্মের মানুষকে মেলাতে চেয়েছেন। সে সময় বাংলার মুসলিম তরুণদের পক্ষ থেকে একাধিক স্থানে কাজী নজরুল ইসলামের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়; তাঁকে সভাপতিত্বও করতে হয়। 

১৯৪১ সালের এপ্রিলে কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেন, তিনি বিশেষ ধর্মের চেয়ে সর্বধর্মের মানুষ হিসেবেই পরিচিত হতে চান। এটিই ছিল নজরুলের জীবনের শেষ অভিভাষণ। তিনি সেখানে বলেন, ‘যদি আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূন্য থেকে অসময়েই নামতে হয়—তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল। সে নজরুল অনেক দিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। সেদিন আমাকে কেবল মুসলমানের বলে দেখবেন না—আমি যদি আসি, আসব হিন্দু-মুসলমানের সকল জাতির ঊর্ধ্বে যিনি একমেবাদ্বিতীয়ম্ তাঁরই দাস হয়ে।’ ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে একের মধ্যে লীন হয়ে যাওয়ার যে ইঙ্গিত নজরুল নিজেকে দিয়ে উল্লেখ করেন তারই কেন্দ্রে রয়েছে মানবতা। কাজী নজরুল সারা জীবন সম্প্রীতিসাধনার মাধ্যমে, মানবতার পবিত্র ভূমিতে স্থিত হতে চেয়েছেন।

ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ না করে শুধু কথার বাহাদুরি দেখাননি নজরুল। নিজে যেহেতু সমন্বয়বাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন, সেহেতু ব্রাহ্মকন্যা আশালতা সেনগুপ্তাকে ধর্মান্তর করে বিয়ের পক্ষে নজরুল ছিলেন না। সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৮৭২ অনুসারে আশালতা-নজরুলের বিয়ে হতে পারেনি এ কারণে যে ওই সময় আশালতার বয়স ছিল ১৬ বছর। কনের বয়স আঠারোর নিচে বলে রেজিস্ট্রি বিয়ে সম্ভব হয় না। বিকল্প হিসেবে আশালতাকে ধর্মান্তর করে বিয়ে অনুষ্ঠানের কথাও বলা হয়। কেননা মুসলিমদের মধ্যে ‘আহ্লুল কিতাব’ অনুসারেও ইহুদি ও খ্রিস্টান ভিন্ন অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করা যায় না, এই মত প্রচলিত আছে। এ অবস্থায়ও আশালতা সেনগুপ্তার সঙ্গে নজরুলের বিয়ে হয় ‘আহ্লুল কিতাব’ মতে।

দৃষ্টান্ত হিসেবে নেওয়া হয় মুসলিম মোগল সম্রাটরা যেভাবে বহু অমুসলিম নারীকে বেগম বানিয়েছেন, সেই প্রক্রিয়া। মোগল সম্রাটদের সেই বেগমরা অন্তঃপুরে নিজধর্ম পালন করেছেন, মুসলিম হননি। নজরুলের কক্ষ-সহচর ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মোজাফফর আহমেদ এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম; স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। নজরুল তাঁর প্রথম সন্তানের নাম দিয়েছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। অবশ্য শিশু অবস্থায় মৃত্যু ঘটে এই ছেলের। তিনি দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার নাম দেন অরিন্দম খালেদ। এভাবে নজরুলের প্রতিটি সন্তানের নামকরণে তিনি বাংলা ও আরবি শব্দের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। এটা শুধু শব্দের সমন্বয় নয়, চেতনার সমন্বয়। নজরুল ইসলাম আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে যা করেছিলেন, আজই বা তা কয়জন করতে পারেন?

আসলে, নজরুল-জীবন ও নজরুল-সৃষ্টি কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতিবিদ্যা অনুসরণ করে বিকশিত হয়নি। কিন্তু এ দুয়ের প্রাণ যে সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের সুতায় বাঁধা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই নজরুল-জীবন ও নজরুল-সৃষ্টির একত্র নাম হতে পারে আন্তর্ধর্মীয় সম্প্রীতিসাধনা; এখানেই নজরুল দার্শনিক।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Harmony, #Kazi Nazrul Islam, #Bidrohi Kobi

আরো দেখুন