বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

অবমাননাকর লোকাচার বাদ দিলে তবেই বেদকে আপন করা যাবে: রোহিনী ধর্মপাল

March 5, 2020 | 4 min read

পুরোহিত বললেই তথাকথিত, চিরাচরিতভাবে আমাদের সমাজ বুঝে নেয়, তিনি পুরুষ ছাড়া মহিলা হতেই পারেন না। আর যদিও বা হন, তাহলে অবশ্যই পুরোহিতের পূর্বে লিঙ্গ বোঝানোর জন্যে ‘মহিলা’ প্রয়োগ করতেই হবে। ‘মহিলা পুরোহিত’।

একবিংশ শতাব্দীর মাটিতে দাঁড়িয়েও আমরা ভুলতে পারলাম না কর্ম নারী-পুরুষ দেখে হয় না। নারী-পুরুষের বিভাজন অহরহ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মনে কাজ করে চলেছে।

বহু বছর ধরেই এ শহরে বৈদিক মতে বিয়ে দিয়েছেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে সংস্কৃতের প্রাক্তন অধ্যাপিকা, প্রয়াত গৌরী ধর্মপাল। যাঁর নিজের বিয়েও হয় এই রীতি মেনে। গৌরী দেবীর সেই বিবাহ পদ্ধতির উত্তরাধিকার ওনার কন্যা রোহিনী ধর্মপাল। 

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে টিম দৃষ্টিভঙ্গি মুখোমুখি হয়েছিল রোহিনী দেবীর। রইল সেই কথোপকথনের কিছু অংশ:

প্রঃ আপনার মা গৌরী ধর্মপালের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে যদি একটু বলেন

রোহিনী: মা নিজে সংস্কৃতের ছাত্রী। বেদের ছাত্রী। প্রথিতযশা ছাত্রী। পরবর্তীকালে তিনি ব্রেবোর্নে পড়াতে যান, এম এ রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই। থার্ড ইয়ারের ছাত্রীদের সঙ্গে মায়ের বয়সের তফাৎ ছিল মাত্র এক বছর। মায়ের ভালোবাসা ছিল সংস্কৃত ভাষা ও বাংলা ভাষা; সমানভাবে। দুটোর যে মেলবন্ধন দরকার সেটা মা বুঝেছিলেন। 

সংস্কৃতমন্ত্র পড়ে যখন আমরা কোনও কাজ করি – সেটা পুজো হোক বিবাহ হোক বা শ্রাদ্ধ হোক – কেউ মানে বুঝি না। মানে না বুঝে আউড়ে যাই বা মন্ত্রগুলো বলিও না। পুরোহিত মশাই এক কোণে মন্ত্র বলতে থাকেন। মা দেখলেন এই মন্ত্রগুলোর অর্থ এত সুন্দর, এগুলো জানাও তো দরকার। আমরা মন্ত্র না জেনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছি; এটা তো একেবারেই শুধুতো বাহ্যিক আচার হয়ে যাচ্ছে, এর সাথে অন্তরের কোনও যোগ নেই। সেই ভাবনা থেকে মা এটার বাংলা করলেন। এবং ঠিক সংস্কৃত মন্ত্রের মতোই ছন্দবদ্ধভাবে।

এই খবর যখন মানুষের কাছে পৌঁছল অনেকেই এগিয়ে এলেন বিবাহ দিতে, যারা ভারতবর্ষকে ভালোবাসেন, দেশের ঐতিহ্যকে ভালবাসেন, এই বাংলাকে ভালোবাসেন। 

মা-বাবার বিয়েও বৈদিক মতে হয়েছে, আড়ম্বর ছাড়াই। অর্থহীন সমস্ত লোকাচার বাদে। মেয়েদের প্রতি অবমাননাকর আচার বাদ দিয়ে। 

প্রঃ মায়ের জীবনে কোনও স্মরণীয় ঘটনা?

রোহিনী: ৯০-এর দশকে একবার শঙ্করাচার্য এসেছিলেন। তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অরুন্ধুতি হোম চৌধুরি বেদ পাঠ করছিলেন। শঙ্করাচার্য তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন যে মেয়েরা বেদ পাঠ করতে পারে না। মেয়েদের বেদ পাঠ করার কোনও অধিকার নেই।  মজার ব্যাপার হল, এই বিবাহ স্তোত্র একটি নারীর লেখা, ঋষি সূর্যা তাঁর নাম। বেদে অনেক এরকম স্তোত্র আছে যা মেয়েদের রচনা। মেয়েরা রচনা করেছেন আর তাতে মেয়েদের অধিকার থাকবে না!

প্রঃ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের এই প্রয়াস কতটা সাফল্য অর্জন করেছে?

রোহিনী: আমরা যদি দেখি, বৈদিক যুগে মহিলা পুরোহিত, মহিলা অধ্যাপিকার উল্লেখ আছে। পরবর্তী সময়ে মেয়েদের জীবনে অন্ধকার যুগ শুরু হয়। মা যখন শুরু করেছিলেন তখন কিন্তু মানুষজন নিজেরাই খোঁজ করে চলে আসতে শুরু করেছিল। তখন এত মিডিয়া কভারেজ ছিল না। একমাত্র বাণী বসু, অপর্ণা সেনের মেয়ের বিয়ের খবর ছাপা হয়েছিল। মানুষ কিন্তু জানতে পেরে এগিয়ে আসে।

এখন যখন এই খবরটা ছড়াচ্ছে আমরা এত ডাক পাচ্ছি যে আমাদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। এক দিনে হয়ত ৭-৮টা বিয়ের ডাক আমরা পাচ্ছি। আমরা না বলতে বাধ্য হচ্ছি। 

প্রঃ আপনার দলে কে কে আছেন? আপনার সঙ্গী কারা?

রোহিনী: আমার দল বলাটাই উচিৎ না কারণ আমার একার পক্ষে এটা করা সম্ভবই ছিল না। আমি নিজে সংস্কৃতের মানুষ নই। বৈদিক স্বরে দক্ষতা আমার নেই। যখনই ভাবনাটা আমার মাথায় এলো তখনই আমি যাকে গিয়ে বলি তিনি হচ্ছেন ডঃ মৌ দাশগুপ্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপিকা। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত। এবং মায়ের সব থেকে প্রিয় ছাত্রী।

সেই থেকে মৌ দি আমার সঙ্গে আছেন। আর একজন যে সংস্কৃত মন্ত্র পাঠ করেন, মৌ দির ছাত্রী – আরসুবি বন্দোপাধ্যায়। গান গায় এবং ইংরাজি পাঠ করে শ্রেয়সী চক্রবর্তী। 

বাংলা না জানা মানুষও এই বিবাহে উৎসাহী হয়েছেন মায়ের সময়। সেজন্যে মায়ের অনুরোধে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজির অধ্যাপিকা ডঃ সতী চট্টপাধ্যায় ইংরাজি পাঠ করে দিতেন। যেখানে শুধু সংস্কৃত ও বাংলা পাঠের দরকার হয় সেখানে সুকন্যা গুপ্ত বলে একজন ও শালিনী মাজি, আর্ষভীর সঙ্গে গানে সহায়তা করে। আর বাংলা পাঠ, যজ্ঞ পরিচালনা এগুলো আমি আর মৌ দি মিলে করি।

প্রঃ ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’ সিনেমাটির অনুপ্রেরণা কি আপনারাই?

রোহিনী: হওয়া উচিৎ ছিল। আমাদের দ্বারা না হলেও গৌরী ধর্মপালের দ্বারা হওয়া উচিৎ ছিল। এটা এখনকার প্রজন্মের দোষ কি না জানি না। এখন আর কেউ উৎস খোঁজে না। সামনে যা পায় সেটা নিয়েই এগোয়। 

আমি জানতাম না এরকম কোনও সিনেমা হচ্ছে। ফেসবুকেই অনেকে আমাকে জানাল। ফেসবুক থেকেই সিনামা পরিচালকের ফোন নম্বর পাওয়া গেল। তাঁকে যখন আমি ফোন করলাম এবং সবটা বললাম, তিনি প্রায় স্তম্ভিত হয়ে গেছিলেন। তিনি সেভাবে কিছুই জানতেন না। তিনি বললেন, যখন এই সিনেমাটা করার কথা ভাবি নন্দিনী দিকে চিনতাম বলে তাঁর কাছেই গেছি। 

তারপর একটা টিম পাঠালেন, আমার ইন্টারভিউ নেওয়া হল। নন্দিনীই ওদের অনুপ্রেরণা ছিল। ভিডিও তৈরী হয়ে গেছিল নন্দিনীর বিয়ে দেওয়া নিয়ে। টিজার দেখলেই বোঝা যাবে। ওই ভিডিও-তে আমার ইন্টারভিউ পরে ঢোকানো হয়েছে।

কিন্তু তারা যখন সত্যিটা জানতে পেরেছেন তখন এগিয়ে এসেছেন, তার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। যখন ওদের মিউজিক লঞ্চ হয়েছিল তখনও আমাদের টিমকে ডাকা হয়েছিল। ঋতাভরী এই বলেই সবার সাথে আমার আলাপ করে দিয়েছিলেন যে ‘এনার মা প্রথম এইভাবে বিয়ে দেওয়া শুরু করেছিলেন’। 

প্রঃ আপনি কি ট্রেলার দেখেছেন? কেমন লেগেছে?

রোহিনী: সিনেমায় সব নাটকীয় করে দেখানো হয়। 

প্রঃ কোন দুঃস্থ ছেলে মেয়ের বিয়ে আপনি দিয়েছেন?

রোহিনী: সামনেই একটি মুসলমান পরিবাবে বিয়ে রয়েছে; তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। তারা খুশি হয়ে যা দেবে, আমরা তাই নেব। শুধু বলেছি আমাদের যাতায়াতের ব্যবস্থাটা করে দেবেন।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#rohini dharmapal, #Bengali Wedding, #woman priestess, #Kolkata

আরো দেখুন