বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

সি ভি রামন – ভারতে বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ

November 7, 2020 | 3 min read

ভারতীয় উপমহাদেশের শুধু নয়, সারা পৃথিবীর যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের পদার্থবিজ্ঞান-শিক্ষার্থী স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন বা সি ভি রামনের নাম শুনেছেন। তাঁর আবিষ্কৃত ‘রামন ইফেক্ট (Raman Effect)’ বা ‘রামন-প্রভাব’ পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এক আশ্চর্য মাইলফলক।

রামন-প্রভাব আবিষ্কারের জন্য স্যার সি ভি রামন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩০ সালে। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, সমগ্র এশিয়ার মধ্যে তিনিই হলেন বিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী। তাঁর নোবেল-বিজয়ী গবেষণার সবটুকুই সম্পন্ন হয়েছিল কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স’ (আই-এ-সি-এস) এর গবেষণাগারে।

এই গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি সংযোজন, সংরক্ষণ ও পরীক্ষণের কাজে রামনকে যিনি সারাক্ষণ সহায়তা করেছিলেন তাঁর নাম আশুতোষ দে। আশুবাবু নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই আশুতোষবাবু জীবনে কোনদিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনার সুযোগ পাননি।

গবেষণার ক্ষেত্রে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না সি ভি রামনেরও। তাঁর কোন গবেষণা-শিক্ষকও ছিলেন না। গবেষণার ক্ষেত্রে নিজেকেই নিজের পথ খুঁজে নিতে হয়েছিল রামনকে। আর তাঁর এই পথ-খোঁজা শুরু হয়েছিল একেবারে ছোটবেলা থেকেই। বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জনকারীদের মধ্যে হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন বিজ্ঞানী ছিলেন যাঁদের কোন নিয়মিত পিএইচডি ডিগ্রি ছিল না। রামন ছিলেন তাঁদেরই একজন। তবে নোবেল পুরষ্কার পাবার আগেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রামনকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি দিয়েছিল।

ব্রিটিশ-ভারতের বিজ্ঞানচর্চাকে অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে উন্নীত করতে স্যার রামনের ভূমিকা অপরিসীম। তাঁর হাতেই সাফল্যের মুখ দেখেছে ব্রিটিশ-ভারতের প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণার লক্ষ্যে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান আই-এ-সি-এস। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার যে উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য সফল করেছেন স্যার রামন। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ব্রিটিশ-ভারতের প্রথম গবেষণা-জার্নাল প্রকাশ করতে শুরু করেন তিনি।

১৯৩২ সাল পর্যন্ত আই-এ-সি-এস ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে ১৯৩৩ সালে রামন যোগ দেন ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের ডিরেক্টর পদে। সেই থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যাঙ্গালোরেই কাটিয়েছেন। চাকরি থেকে অবসরের পর নিজের সঞ্চিত অর্থ ও জনগণের চাঁদায় তিনি স্থাপন করেছেন রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউট।

স্যার রামন বিশ্বাস করতেন নিয়মিত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকলে কোন বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করতে পারে না। তাই তিনি কখনোই কোন সরকারি অনুদান গ্রহণ করেননি। স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু অনেক কষ্টে তাঁকে রাজি করিয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক পদ গ্রহণ করার জন্য। ভারতের উপরাষ্ট্রপতির পদও উপেক্ষা করেছিলেন স্যার রামন। তাঁকে দেশের সবচেয়ে সম্মানজনক উপাধি ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করে ভারত সরকার।

বিজ্ঞানের গবেষণা করার জন্য, বিরাট অংকের বেতন ও অন্যান্য সুযোগসুবিধাসহ সরকারি চাকরি ছেড়ে অর্ধেকেরও কম বেতনের বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক হয়েছেন। বিজ্ঞানের জটিল ব্যাপারগুলোকে এমন সরল করে বোঝাতে পারতেন যে ছাত্ররা বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত হয়ে পড়তো। দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক ছাত্র এসে জড়ো হয়েছেন রামনের গবেষণাগারে তাঁর সাথে কাজ করার সুযোগ লাভের জন্য।

ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞানসংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রামনের অবদান অপরিসীম। তিনি বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি না হলেও চলে। শুধু দরকার হয় অনুসন্ধিৎসু মন। তিনি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করতেন, “সাবানের ফেনায় ভেসে বেড়ানো রঙ দেখেছো? আকাশ কেন নীল জানো? হীরা কেন এত উজ্জ্বল? ফুলের পাপড়ির যে রঙ সেই রঙের রহস্য কী?” আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতেই রয়েছে কত রহস্য। সঠিক প্রশ্ন করতে জানলে প্রকৃতি তার রহস্যের দরজা খুলে দেয়।

কলকাতায় অ্যাসোসিয়েশানে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে রামন নোবেল পুরষ্কার নিয়ে এসেছিলেন সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল তাঁর স্থাপিত ওয়ার্কশপে স্থানীয় কারিগরদের দ্বারা তৈরি। ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের ডিরেক্টর পদে থাকাকালীন গবেষক ছাত্রদের দিয়ে যন্ত্রপাতি বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। 

রামন নিজে শুধু গবেষক ছিলেন না, ছিলেন গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরির পরশ পাথর। স্যার কৃষ্ণান, হোমি ভাবা, বিক্রম সারাভাই প্রমুখ ছিলেন রামনের সরাসরি ছাত্র ও গবেষণা-সহযোগী। কলকাতার মহেন্দ্রলাল সরকারের হাতে গড়া সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশান রামনের হাতে পুনর্জন্ম লাভ করে। রামন ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই অ্যাকাডেমি এখন পূর্ণোদ্যমে কাজ চালাচ্ছে। রামনের নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউট এখন একটি স্বায়ত্বশাসিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে রামনের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে সগৌরবে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#CV Raman, #Scientist

আরো দেখুন