দেশ বিভাগে ফিরে যান

নোটবন্দি – দেশের মঙ্গল নাকি রাজনৈতিক সাফল্য

November 8, 2020 | 4 min read

গত চার বছরে এই কথাটা বার বার উঠে এসেছে যে, নোটবন্দির নেতিবাচক কোন প্রভাব নির্বাচনে তো পড়েইনি, বরং তা বিজেপির পালে হওয়া দিয়েছে। নির্বাচন চলাকালীন সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিকাল অর্গানাইজেশন (সিএসও)-র প্রকাশিত ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৬) তথ্য উঠে আসে যাতে দেখা যায় বিগত বছরের তুলনায় ভারতীয় জিডিপি ৭ শতাংশ হারে বেড়েছে।  

উল্লেখ্য, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে বিমুদ্রাকরণ হলো এক স্বৈরাচারী পদক্ষেপ, যা অর্থনীতির মূল বুনিয়াদ পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। অর্থনীতিতে এর খারাপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বিমুদ্রাকরণকে আমজনতার উপর ‘সংগঠিত লুণ্ঠন ও আইনগত দস্যুবৃত্তি’ বলে বর্ণনা করেন ও আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে জি ডি পি ২% হ্রাস পাবে। 

অনেকে বলছেন বিমুদ্রাকরণ আখেরে মোদীর নির্বাচনী সাফল্য কাজ করেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে সিএসও জিডিপি পরিসংখ্যান সামনে এসে পড়াতে মোদী বিমুদ্রাকরণকে তার সাফল্য বলে জোর গলায় প্রচার করতে পেরেছেন। তাঁর রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিরোধীদের বিরুদ্ধে গলা চড়িয়েছেন এবং এসবই তাঁর নির্বাচনী পালে হাওয়া লাগিয়েছে। 

বিমুদ্রাকরণ এবং বিজেপি-র নির্বাচনী সাফল্য

সাফল্য একবার আংশিকভাবে এলে সেটার দৌলতে ভিতরের সত্য কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রেখে দিনকে রাত বানানো মোটেও কঠিন কিছু নয়। তাই বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোট কাটাকুটির খেলায় কে বেশি আসনসংখ্যা দখল করে ক্ষমতা পেল সেটাই যেন সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে দাঁড়ায়। 

অথচ বিমুদ্রাকরণের প্রভাব বুঝতে গেলে মোট প্রদত্ত ভোটের কত শতাংশ তুলনামূলক বিচারে বিজেপি-র প্রতি আস্থা রেখেছে তা বোঝা দরকার। প্রথমত, একটা কথা প্রথমেই মনে রাখা দরকার, নোটবন্দির পরবর্তীকালে যে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে তা দেশের উত্তর, পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব অংশ জুড়ে বিস্তৃত। এই পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে কেবলমাত্র উত্তর ভারতের দুটি সংলগ্ন রাজ্য উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড বাদে কোথাও বিজেপি আসনসংখ্যার নিরিখেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। 

সুতরাং যারা শুধুমাত্র উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের নির্বাচনী ফলাফলের ভিত্তিতে যুক্তি দিচ্ছেন যে দেশের মানুষ মোদীর বিমুদ্রাকরণের পক্ষে আস্থা জানিয়েছেন, একই যুক্তিতে বলা যায় দেশের বাকি উত্তর, পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মানুষ বিমুদ্রাকরণের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন।   

বিভিন্ন রাজ্যে ২০১৪-র লোকসভা ও ২০১৭-র বিধানসভায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের শতকরা শেয়ার

সাল উত্তর প্রদেশ উত্তরাখণ্ড পাঞ্জাব মণিপুর গোয়া

২০১৭ ৩৯.৭ ৪৬.৫ ৫.৪ ৩৬.৩ ৩২.৫

২০১৪  ৪২.৩ ৫৩.৩ ৮.৭ ১১.৯ ৫৩.৪ 

সাধারণ মানুষের হয়রানি ও কর্পোরেট লুণ্ঠন

মানুষ বিমুদ্রাকরণের পক্ষে রায় দিয়েছেন একথা যেমন কোনমতেই প্রমাণ হয়নি, তেমনই মানুষকে বিমুদ্রাকরণের বিরুদ্ধে সাঙ্ঘাতিক রকমের বিরোধিতা করতেও দেখা যায়নি। অথচ স্বল্পকাল ও দীর্ঘকাল দুয়েই গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের ক্ষতির অঙ্ক সব থেকে বেশি। 

বিমুদ্রাকরণের আগে অবধি ভারতবর্ষের মোট লেনদেনের ৯৮%-ই হতো নগদ টাকায়। এইরকম একটা অর্থনীতি আচমকা ৮ই নভেম্বর ২০১৬ প্রধানমন্ত্রী ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট যা মোট মুদ্রার ৮৬%, বাতিল বলে ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে এটিএম-এ প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২০০০ টাকার বেশি তোলা যাবে না বলে ঘোষণা করা হয়। বেশির ভাগ এটিএম-এ ‘নো ক্যাশ’ বোর্ড ঝুলতে থাকে। ব্যাঙ্ক শুধু ২০০০ টাকার নোট দিতে শুরু করলো, যা কোন লেনদেনে প্রদান করলে খুচরোর অভাবে মানুষ প্রত্যাখ্যাত হয়ে চরম হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়। 

প্রথমে মানুষকে বোঝানো হয় তাদের এই কষ্ট সাময়িক। কারণ বিমুদ্রাকরণের মূল উদ্দেশ্য হলো কালো টাকা ও সন্ত্রাসবাদকে খতম করা। অর্থাৎ কালোবাজারি ও সন্ত্রাসবাদীদের হাতে যে বিপুল পরিমাণ ৫০০ ও ১০০০ টাকার বান্ডিল জমে আছে তা এবার শেষ হবে। বলিউডের হিন্দি ছবিতে মানুষ বড় বড় ভিলেন যারা কালোবাজারি ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত, তাদের ৫০০ ও ১০০০-এর নোট স্যুটকেস এবং সিন্দুকে বোঝাই হয়ে আছে দেখতেই অভ্যস্ত। 

গরিব আমজনতার একাংশ নিজেদের ক্ষতিস্বীকার করেও প্রধানমন্ত্রীর এই গল্প বিশ্বাস করেছিলেন। যদিও আসল তথ্য হলো মোট কালো টাকার (যা নাকি জিডিপি-র ২৫%) মাত্র ৬% তরল অর্থ হয়ে অর্থনীতিতে ঘুরছে এবং কালোবাজারিরা তা সব সময় বিনিয়োগের মাধ্যমে খাটাচ্ছে, যার জন্য সরকার কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

অচিরেই প্রধানমন্ত্রীর এই মিথ্যে ধরা পড়ে গেল, যখন দেখা গেল বাতিল হওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার প্রায় সবটাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জমা পড়েছে। এবং সরকারের নির্দেশে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পুরানো ৫০০ ও ১০০০-এর জোগান নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে। কালো টাকা ও সন্ত্রাসবাদের মিথ্যের ফানুস ফেটে যেতে প্রধানমন্ত্রী এবার নতুন স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলেন, ভারত নাকি বিমুদ্রাকরণের ফলে অচিরেই ক্যাশহীন ডিজিটাল অর্থনীতিতে পরিণত হবে। 

এই দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। মেয়েদের ক্ষেত্রে ৮০%-ই ব্যাঙ্কবিহীন। মাত্র ৭% নিম্ন আয়যুক্ত পরিবারে স্মার্ট ফোন আছে। দেশের মাত্র ২৭% মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং তাঁদের মধ্যে ৮৭%-ই বড় শহরের বাসিন্দা। ৯৮% ক্যাশ ব্যবহৃত, ডিজিটাল পরিকাঠামোহীন অর্থনীতিতে ‘ডিজিটাল ভারত’ শুধুই ‘রুপকথা’-র গল্প। 

আসল সত্যটা হলো টাকার অভাবে বিক্রি-বাট্টায় এক বিরাট মন্দা নেমে আসে। বহু শ্রমিক কাজ হারান। অসংগঠিত ক্ষেত্রের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ও কৃষকরা পথে বসেন। পাড়ার মুদির দোকানগুলো চোখে সরষে ফুল দেখে। শহরাঞ্চল ভিড় করে স্পেনসার্স ও রিলায়েন্সের শপিং মলে। ফুলে ফেঁপে ওঠে পেটিএম, বেসরকারি ব্যাঙ্ক ও কর্পোরেট ক্ষেত্র।   

জাতীয় আয়ের মিথ্যে প্রচার  

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে শোনা যায় জাতীয় আয় নাকি ৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। যা সরকারের ধূর্তামি ছাড়া আর কিছুই না। প্রথমত, এটি ছিল আগাম পরিসংখ্যান। সংশোধিত পরিসংখ্যানে যা নিচে  নামবে বলেই অর্থনীতিবিদদের ধারণা ছিল এবং তাই হয়েছে। 

দ্বিতীয়ত, ঠিক এভাবে ২০১৫-১৬-র সংশোধিত জিডিপি নিচে নেমেছিল, আর সেই নিচু ভিত্তির উপর ভর করেই ২০১৬-১৭-র আগাম জি ডি পি উঠে গেছিল ৭%-এ। তৃতীয়ত জাতীয় আয়ে যেহেতু ভরতুকি হ্রাস ও পরোক্ষ করের ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছে; এই দুই জিডিপি থেকে বাদ দিয়ে গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড (জিভিএ) পাওয়া যায়। যাতে দেখা যাচ্ছে জিভিএ-র বৃদ্ধি ১.২% কমেছে, যা আসলে বিমুদ্রাকরণের ফল। 

চতুর্থত, জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির মূল উৎস হলো শিল্প যা সিএসও-র মতে ৭.৭%। অনেকেরই মতে শিল্পোৎপাদন সূচকের পরিবের্ত নতুন পরিমাপ পদ্ধতির অবলম্বনেই কোম্পানি মন্ত্রকের রিপোর্টে দেখা যায় সিএসও-র মিথ্যে শিল্প বৃদ্ধির হার। বিশেষত যেখানে শিল্পোৎপাদন সূচক কোন বৃদ্ধিই দেখাচ্ছে না। 

আরও গোলমেলে ব্যাপার হলো নতুন পরিমাপ পদ্ধতি কোন এক জাদুতে পুরো অসংগঠিত ক্ষেত্রই (যা মোট শিল্পের ৫৫%) বাদ চলে গেছে; যা বিমুদ্রাকরণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। একইরকমভাবে সিএসও পরিসংখ্যানের মার প্যাঁচে বেসরকারি ভোগব্যয় ১০% বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। 

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Note Bondi

আরো দেখুন