অপারেশন সূর্যোদয় – নন্দীগ্রামে কী ঘটেছিল
পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) রাজনৈতিক ইতিহাসে নন্দীগ্রামের (Nandigram) নাম অবিস্মরণীয়। সেখানে কেমিক্যাল হাব গড়ে তোলার প্রস্তাব ঘিরে যে গণপ্রতিরোধ ও নানা রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়েছিল, যেভাবে শাসকের নির্মমতা প্রকাশ্যে এসেছিল চরম অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে, তা ভোলার নয়। ২০০৭-এর সেই কুখ্যাত ১৪ মার্চ, যে দিন নন্দীগ্রামে নির্বিচার গুলি চালিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের (Buddhadeb Bhattacharya) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ, মৃত্যু হয়েছিল ১৪ জনের, সেই ১৪ মার্চ, ঘটনাচক্রে, কার্ল মার্কসেরও মৃত্যুদিন। ঐতিহাসিক সমাপতনই বটে!
দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে কী ঘটেছিল নন্দীগ্রামে? কী ভাবে, কোন ঔদ্ধত্যে বুদ্ধদেববাবু জনমানসকে গুরুত্বই দিতে চাননি? সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জমি অধিগ্রহণ একটা বড়সড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সৃষ্টি হয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম অধ্যায়ের, যে অধ্যায় দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের জগদ্দল পাথর সরানোর পক্ষে মস্তবড় সহায়ক হয়ে ওঠে। কার্যত বিরোধীহীন পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায় তৃণমূল। বস্তুত, সিপিএম সরকারের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছিল নন্দীগ্রাম।
এই প্রসঙ্গে অশ্যই উল্লেখ করতে হয় সাংবাদিক বিতনু চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ের কথা। তাঁর ‘নন্দীগ্রাম – আসলে যা ঘটেছিল’ নন্দীগ্রামের জমি বাঁচাও আন্দোলনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মুগ্ধ করে। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো এই বইটি তুলে ধরে এক কালো ইতিহাস। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির রণকৌশল, সেই আন্দোলন ভেঙে দিতে শাসক দল সিপিএমের পাল্টা ছক, নন্দীগ্রামের বধ্যভূমিতে বুলেট আর অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ, নানা নাটকীয় চরিত্র— যেন পরতের পর পরত খুলেছে এই চিত্রনাট্যের।
যেমন ‘মাস্টারদা’! ফ্রন্টলাইন নন্দীগ্রামে একেবারে সামনে থেকে বন্দুক হাতে সিপিএমের যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন এই নেতা। দীর্ঘ দিন ধরেই যে অভিযোগ উঠত, বহিরাগত ‘হার্মাদ’দের দিয়ে সিপিএম নন্দীগ্রামের হারানো এলাকা উদ্ধার করতে পথে নেমেছে, এই গ্রন্থে ‘মাস্টারদা’র বয়ান সে কথারই মান্যতা দিয়েছে! সময়কালের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে বিতনু দেখিয়েছেন, কী ভাবে, কোন কোন এলাকা থেকে সিপিএম বাইরের শক্তিকে নন্দীগ্রামে নিয়ে এসেছিল। ‘মাস্টারদা’ জানিয়েছেন, কী ভাবে সিপিএম আবার নন্দীগ্রাম দখল করেছিল।
২০০৭-এর ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রাম পুনর্দখল করে সিপিএম (CPM)। সিপিএমের ভাষায়: ‘অপারেশন সূর্যোদয়’। ১৩ নভেম্বর মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেই ঐতিহাসিক উক্তি করেছিলেন, ‘দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন।’ তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী এই পৈশাচিক ঘটনাকে বলেছিলেন ‘হাড় হিম করা সময়’।
বাংলা আজ আরেক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। মানুষের কাছে আবার এক প্রশ্ন উঠে এসেছে। ভবিষ্যতের সিদ্ধান্তে তাই ফিরে দেখা উচিৎ অতীতকেও। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের মত সামাজিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ফিরে দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।