ভাইফোঁটার ইতিবৃত্ত
বিভিন্ন স্থানে ভাইফোঁটাকে ঘিরে নানা লোকাচার। কেউ ফোঁটা দেন আবীরে, কেউ বা আবার শিশিরে। কেউ ভাইকে ফোঁটা দেন চন্দনে কেউ বা ঘি, দই দিয়ে। খাবার দাবার নিয়েও নানা নিয়ম। কেউ ভাইকে পান ছেঁচে তবে খেতে দেন যাতে, পান চিবোতে ভাইয়ের কষ্ট না হয়। কেউ বা আবার ভাইকে নিমপাতা খাইয়ে বিপদ থেকে রক্ষা করেন। শেষ পাতে এক থালা মিষ্টি থাকবেই। আর সাথে থাকবে নানা ব্যঞ্জন।
কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে, অর্থাৎ কালীপুজোর দু’দিন পরে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালিত হয়। কখনও আবার কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের প্রথম দিনেও উদযাপিত হয়ে থাকে। পশ্চিম ভারতে এই উৎসবের নাম ভাইদুজ। আবার, মহারাষ্ট্র (Maharashtra), গোয়া (Goa), কর্ণাটকে (Karnatak) ভাইফোঁটার নাম ভাইবিজ। নেপালে আর আমাদের রাজ্যেই দার্জিলিং-এ (Darjeeling) এই উৎসবের নাম ভাইটিকা। নেপালের কোথাও কোথাও এই উৎসবকে ভাইলগন বা ভাতিলগন বলা হয়।
এই উৎসবের আরও একটি নাম যমদ্বিতীয়া। আর তার পিছনে রয়েছে এক বহুশ্রুত কাহিনি। আর সেই কাহিনি থেকেই বিখ্যাত ভাইফোঁটায় বোনের, দিদিদের ছড়া—
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
এর সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা অনুসারে এই বাংলাতেই ছড়ায় আরও কয়েকটি লাইন যুক্ত হয়। কোথাও বা হয় না।
পুরাণ অনুসারে, মৃত্যুদণ্ডদাতা যমরাজ ও তাঁর বোন যমুনা হলেন সূর্যের দুই সন্তান। যম ও যমুনা যমজ ভাই বোন। বড় হয়ে তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে থাকতেন। দীর্ঘকাল দেখা না হওয়ায় বোন যমুনার খুব ইচ্ছে হয় ভাই যমকে দেখার। নিমন্ত্রণ পেয়ে ভাই যমরাজ এলে ভালমন্দ খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে প্রার্থনা করেন। বোনের ডাক পেলে বারবার আসার প্রতিশ্রুতি দেন যম। সেই কাহিনি থেকেই নাকি ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন। সেই থেকেই ভাইয়ের কল্যাণে অনুষ্ঠিত হয় এমন পরব। কিন্তু তা হলে তো বোনেরা যমুনার প্রতীক, আর ভাইয়েরা কি যম? না, এমন প্রশ্ন তোলা যাবে না কারণ, ভাইফোঁটার যে ছড়া, তাতে তো যমের দুয়ারে কাঁটা দিতেই দিদি-বোনেদের এত আয়োজন।
এখানেই কাহিনির শেষ নয়। যমুনার সঙ্গে বিয়ে হয় শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামের। সেই দিনটিও ছিল কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। বিয়ের আগে ভাইদের কপালে ফোঁটা দিয়ে মঙ্গলকামনা করেছিলেন যমুনা। সেই থেকেও ভাইফোঁটার প্রচলন বলেও অনেকে বলে থাকেন।
আবার সর্বানন্দসুরী নামে এক আচার্য পণ্ডিতের তালপাতার পুথি ‘দীপোৎসবকল্প’ থেকে জানা যায় অন্য কাহিনি। চতুর্দশ শতাব্দীর সেই পুথি অনুসারে, জৈন ধর্মের অন্যতম প্রচারক মহাবীর বর্ধমানের মহাপ্রয়াণের পরে তাঁর অন্যতম সঙ্গী রাজা নন্দীবর্ধন মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন। সেই সময়ে তাঁর বোন অনসূয়া নন্দীবর্ধনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান এক কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে। সেখানে অনেক প্রার্থনার পরে নন্দীবর্ধন বোনের কাছে অনশন ভঙ্গ করেন। এই কাহিনি সত্যি হলে ভাইফোঁটা উৎসবের বয়স আড়াই হাজার বছরের বেশি। কারণ, মহাবীরের প্রয়াণ বছর ৫২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
কার্যত শারদীয়া উৎসবের শেষ ভাইফোঁটা দিয়ে। আর শারদীয়া উৎসবের সবকিছুর সঙ্গেই রয়েছে মা লক্ষ্মীর যোগ। সেটা ভাইফোঁটার ক্ষেত্রেও সত্য। এমনই এক পৌরাণিক কাহিনি শোনা যায়। একসময়ে বলির হাতে পাতালে বন্দি হন বিষ্ণু। বিপদে পড়ে যান দেবতারাও। কোনওভাবেই যখন বিষ্ণুকে উদ্ধার করা যাচ্ছে না, তখন নারায়ণকে বলির হাত থেকে উদ্ধার করতে সকলে লক্ষ্মীর শরণ নেন। লক্ষ্মী উপায় হিসেবে বলিকে ভাই ডেকে কপালে তিলক এঁকে দেন। সেটাও ছিল কার্তিক মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথি। ফোঁটা পেয়ে বলি লক্ষ্মীকে উপহার দিতে চান। আর তখনই লক্ষ্মী, ভগবান বিষ্ণুর মুক্তি উপহার চান।
আবার এমনও বলা হয় যে, কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুর বধ করেছিলেন। সেই জন্যই নাকি ভাইকে নরকাসুর বধকারী শ্রীকৃষ্ণ কল্পনা করে পুজো করেন বোনেরা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই দিনের জন্য বিশেষ আলপনা দেওয়া হয়। চৌকন, চোকনা, চুকনা ইত্যাদি নানা নামের সেই চালের গুঁড়োর আলপনার মাঝখানে ভাইকে বসিয়ে ফোঁটা দেওয়া হয়। নেপালে আবার ভাই ঘুমিয়ে থাকার সময়ে ভাইয়ের কপালে পোড়া চালের ফোঁটা পরিয়ে দেন বোনেরা। এর ফলে নাকি, কোনও অশুভ শক্তি ভাইকে স্পর্শ করতে পারে না।
উৎসবের আসল লক্ষ্যই হল কল্যাণ কামনা। তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নানা কাহিনি, নানা কথা, নানা রীতি ও উপচার। আর সেই কল্যাণ কামনা থেকেই ভাইফোঁটা আজ এক সামাজিক উৎসব।