পুলুর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ কৃষ্ণনগর
সবার কাছে তিনি ফেলুদা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হলেও কৃষ্ণনগরবাসীর কাছে তিনি পুলু। ডাকনামেই তাঁকে বেশি চেনে এই শহর। কালীপুজোর আনন্দের আবহেই ছন্দপতন। খারাপ খবরটা এসেই গেল, পুলু আর নেই। শোকস্তব্ধ কৃষ্ণনগর (Krishnanagar)। রবিবার সকাল থেকে শহরের প্রবীণ মানুষজন বাড়ির ছোটদের বারবার জিজ্ঞাসা করছেন, একেবারেই কী নিশ্চিত যে উনি আর নেই? দুপুরের মধ্যে তাঁর মৃত্যুর ঘোষণা করার পরেই শোকে ভেঙে পড়েন অনেকে। ‘ফাইট, কোনি ফাইট’ বলে লড়াইয়ের মঞ্চে অবিচল থাকতে শিখিয়েছেন যিনি, তিনিই শেষ পর্যন্ত হার মানলেন মৃত্যুর কাছে! চলচ্চিত্র জগতের সংসার ছাড়লেন অপু।
চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়ায়। স্বাধীনতার অনেক আগেই অবশ্য সপরিবারে কৃষ্ণনগরে চলে আসেন তাঁরা। তারপর এখানেই বসবাস শুরু করেন। সৌমিত্রবাবুর জীবনের প্রথম দশ বছর কেটেছে এই শহরে। এখানকার সিএমএস স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। বাবা মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের বদলির চাকরি ছিল। সেই সূত্রে ছোটবেলায় পুলুকে স্কুল বদলাতে হয়। এই শহরের বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় লেন বা সোনাপটি এলাকায় জীর্ণ পৈতৃক বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে। বতর্মানে এই বাড়িতে সিপিএমের এরিয়া কমিটির অফিস হয়েছে। তবে ‘সুধা নিলয়ে’র সঙ্গে আজও আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছেন অনেক মানুষ। সামনের দোকানের মিষ্টি ছিল তাঁর বড়ই প্রিয়। সে কথাও জানালেন এলাকার লোকজনই। ওই বাড়ির তিনতলার ঘরে, উঠোনে কিশোর সৌমিত্র পরিবারের লোকের সঙ্গে নাট্যচর্চাও করতেন। দেওয়ালে মঞ্চের নকশা ঝাপসা হলেও পুরোপুরি উঠে যায়নি। শহরের বাসিন্দা বিশ্বনাথ দাস ওই তিনতলার ঘরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, আমরা বরাবরই শুনে এসেছি, ওঁর পরিবারের লোকজন এখানে এই ঘরে নাট্যচর্চা করতেন।
সৌমিত্রবাবুর (Soumitra Chatterjee) ছোটবেলার বন্ধু সন্ধ্যা মজুমদার। তাঁর ডাকনাম বুড়ু। সেই নামেই ডাকতেন সৌমিত্রবাবু। বন্ধুর শরীর যে একেবারেই ভালো নেই তা জানতেন সন্ধ্যাদেবী। রবিবার সকাল থেকেই তাঁর মন খারাপ ছিল। বললেন, সকাল থেকেই মনটা যেন কু-ডাকছিল। দুপুরে খারাপ খবরটা পেলাম। এরপরই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, কালীপুজোর বিসর্জনের মধ্যেই এই খবর। আমি সকালে ঘুম থেকে উঠেই বললাম, পুলুর আজকেই না কিছু একটা হয়ে যায়! মনে হয় স্বপ্নই দেখলাম। দু’মাস আগেও ফোন করেছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল, তোর কী দরকার? ও খুব ভালো মানুষ। কোনও দাম্ভিকতা বা অহংকার একদিনও দেখলাম না। সরপুরিয়া খেতে খুব ভালোবাসত। ডাল-ভাত, একটা মাছ, একটু সাদা দই হলেই ও খাওয়ায় তৃপ্তি পেত। ওর বিয়ের অনেক দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়েছিল। এরপর খানিক থেমে চোখ মোছেন বৃদ্ধা। আবার বলে চলেন আপন মনে, এখানে বেশিদিন ওরা থাকেনি। ওর বাবার বদলি হয়ে গেল। খুব ভালোবাসত আমাকে। অনেক দিন দেখা হয়নি। কৃষ্ণনগরে এসেছিল, খবরও দিয়েছিল, আমার অশক্ত শরীর, আমি যেতে পারিনি। শহরের নাট্যব্যক্তিত্ব শিবনাথ ভদ্র বলেন, ২০১৭সালে শেষবার কৃষ্ণনগরে একটি নাটক করতে এসেছিলেন। ২০১৮সালে আসার কথা ছিল, শরীর খারাপ থাকায় আর আসতে পারেননি। সেইসময় আমার সঙ্গে কথাও হয়। ওঁর বাড়ির সকলে মিলে বাড়ির উঠোনে নাট্যচর্চা করতেন। শুরুটা ওখানেই। ওঁর মুখ থেকেই শোনা, মায়ের থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রথম চেনেন তিনি। স্কুলেও এক শিক্ষক ওঁকে নাটকের তালিম দিয়েছিলেন। নানান অনুষ্ঠানে একাধিকবার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বারবার নস্টালজিয়ায় ডুবে যেতেন। শহরের আর এক বাসিন্দা বলেন, তাঁর কাজের মাধ্যমেই আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন সৌমিত্রবাবু। আমরা আপনজনকে হারানোর শোক অনুভব করছি।