কি করে শুরু হল চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো
বাংলায় তখন পর্তুগীজদের রমরমা। সরস্বতীর নদীখাত শুকিয়ে যাওয়ার পরেই পর্তুগীজরা চলে আসে হুগলীতে। সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে মুঘল বাদশাহ শাহজাহানের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হুগলী থেকে বিদায় নেয় পর্তুগীজরা। ধীরে ধীরে হুগলী নদী ব্যবসা বাণিজ্য ও পরিবহণের মূল মাধ্যম হয়ে ওঠে। ভারতের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়ের যবনিকা পতন সেখানেই। পর্তুগীজদের যাওয়ার সাথেই তিনটি ঔপনিবেশিক শক্তি হগলী নদীর তীরে বাণিজ্য তরী ভেড়ায়। চুঁচুড়ায় ওলন্দাজ, হুগলীতে ব্রিটিশ এবং চন্দননগরে ফরাসীরা। শুরু হয় ঔপনিবেশিক শক্তি আস্ফালনের পরবর্তী অধ্যায়। চন্দননগর ছিল সেকালে বাঙলার শস্য ভাণ্ডার। এখানকার চাউলপট্টি এলাকা তখনকার দিনে বাণিজ্যের দিক থেকে দক্ষিণ বঙ্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই চাউলপট্টির জগদ্ধাত্রী পুজো তিনশ বছরেরও প্রাচীন বলে শোনা যায়। এখানকার জগদ্ধাত্রী হলেন চন্দননগরের “আদি মা”। শোনা যায় এই পুজোর প্রচলন করেন ফরাসী দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।
ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী তৎকালীন চন্দননগরের চাউল পট্টির মামুলি ব্যবসায়ী থেকে নিজের বুদ্ধি এবং কর্ম তৎপরতার জোরে হয়ে ওঠেন ফরাসী ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ান। ইন্দ্রনারায়ণের জন্ম বর্তমান যশোর জেলার সর্বরাজপুর গ্রামে। জীবনের নানা ওঠানামার মধ্যে দিয়ে এই পিতৃহীন বালকের পরিবারটি মুর্শিদকুলী খাঁয়ের বদান্যতায় চন্দননগর অঞ্চলে এসে পৌঁছয়। পরবর্তীকালে ইন্দ্রনারায়ণের বড়ভাই রাজারাম মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে হিসাব রক্ষণের কাজে নিযুক্ত হন। ভাই ইন্দ্রনারায়ণ চাউলপট্টিতে চালের ব্যবসা শুরু করেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই বেশ উন্নতি করেন। ফরাসীদের আরেক ট্রেডিং সেন্টার পন্ডিচেরীতে একবার চাল ভর্তি জাহাজ পাঠিয়ে তিনি প্রভূত লাভের মুখ দেখেন। তবে ফরাসীদের সাথে সখ্যতা ইন্দ্রনারায়ণের আরও ছোটবেলা থেকেই। ফরাসডাঙার নগরের বাইরেই অনতিদূরে সেকালে প্রচুর জঙ্গল ছিল এবং ফরাসীরা সেকালে হাঁস শিকার করার জন্য এই জঙ্গলে আসত। বালক ইন্দ্রনারায়ণ হতেন তাঁদের গাইড। এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি রপ্ত করেছিলেন ফরাসী আদব কায়দা ও কাজ চালানো ফরাসী ভাষা। শোনা যায় এভাবেই তিনি মামুলী চালের ব্যবসায়ী থেকে কোম্পানীর এজেন্ট পদে নিযুক্ত হন। এই সময়েই তাঁর আলাপ হয় নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। শুধু আসা যাওয়াই নয়, সময়ে অসময়ে ইন্দ্রনারায়ণ তাঁকে অর্থসাহায্য করেছেন বলেও শোনা যায়। আর এই দুই বন্ধুর সখ্যতার কারণেই কৃষ্ণচন্দ্র-প্রবর্তিত কৃষ্ণননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর অনুকরণে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরিও জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন বলে শোনা যায়।
১৭৪২ সালে ১২ লক্ষ টাকা অনাদায়ী খাজনার অপরাধে আলিবর্দি খান কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে কারারুদ্ধ করেন। এই সময় তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হন এবং নবাবের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কৃষ্ণনগর ফিরে গিয়ে তিনি জগদ্ধাত্রী পুজা শুরু করেন। এই মত যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয় কৃষ্ণনগরের পুজো শুরু হওয়ার পর। অর্থাৎ কিনা ১৭৬২-র আশেপাশে। সেক্ষেত্রে এ পুজো দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য ইন্দ্রনারায়ণের হয়নি।
অপর একটি মতানুসারে, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো তার আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। খোদ ইন্দ্রনারায়ণের বাড়িতেই জগদ্ধাত্রী পুজো হত। চাউলপট্টির জগদ্ধাত্রীই সেই আদি মা। ১৭৫৭ সালে ক্লাইভের চন্দননগর লুঠের সময় সে পুজো বন্ধ হয়ে যায়, যা আবার শুরু হয় কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলনের অব্যবহিত পরে। আজও শোনা যায়, চাউলপট্টির আদি মায়ের পুজোর সংকল্প হতো ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর পরিবারের নামে, এবং পাঁঠা বলির পর একটি করে প্রসাদী পাঁঠা প্রতিবার চৌধুরী বাড়িতে পাঠানোর রীতি বছর পঁচিশ আগেও চালু ছিল।