বন বাংলোয় খাবার বাহার
ভাত, মুগের ডাল, ডিমের ডালনা। সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ ও কাঁচা লঙ্কা। শিউলি ফুলের মতো ঝরঝরে, অথচ না-শক্ত ভাত। ঈষৎ ঘন, পীতাম্বরী মুগডালের প্রতিটি দানা আলাদা করে ঠাহর করা যাচ্ছে, আবার গলেও যাচ্ছে মুখে দিলে। মিষ্টি ও নুনে অদ্ভুত ভারসাম্য। ডিমের ডালনার রং ঈষৎ স্বর্ণাভ। প্রতিটি ডিমের কুসুম সুসিদ্ধ, অথচ অতিরিক্ত সিদ্ধ হয়ে ধূসর রং ধরেনি। সিদ্ধ ডিমের সব ক’টি ভাজাও হয়েছে সমান মাত্রায়। এমন নয় যে, কোনওটা বেশী লাল আবার কোনওটা সাদা। ডালনায় দেওয়া আলু একটু একটু ভেঙে ঘন তরলে মিশে তাকে আরও মনোহর করে তুলেছে।
গন্তব্য, ডুয়ার্সের গোরুমারা বন বাংলো। খাবারের যাবতীয় কাঁচা উপকরণ নিয়েই বন বাংলোয় ঢোকা দস্তুর। কিন্তু পৌঁছতে দেরি হয়েছিল, তাই বাংলোর কেয়ারটেকার-কাম-কুক গোপালদা রাতের জন্য মাছ-মাংস তুলে রেখে লাঞ্চে ওই ডিম-ভাতের ব্যবস্থা করে দিলেন ঝটিতি। সাদামাঠা মেনু তবে স্বাদে স্বর্গীয়।
মামুলি উপকরণ দিয়ে অসাধারণ খাবার তৈরীতে, খাবার সৃষ্টিতে এই বন বাংলোর রাঁধুনিরা মা-ঠাকুমা-দিদিমাদের চেয়ে কিছু কম যান না। আসলে কাজের সূত্রে মন্ত্রী ও বড় বড় অফিসারদের প্রায়শই বিভিন্ন বন বাংলোয় থাকতে হয়, খেতে হয়। তাই, ওস্তাদ রাঁধুনি না-থাকলে মুশকিল। এবং সেই ওস্তাদির মাত্রাই আলাদা। পাকা গিন্নিদের হাতের মতো ওই সব রাঁধুনির অনেকের হাতেই ফুলকো লুচি হয় পুরোপুরি সাদা, কোনও লালচে দাগ গায়ে ধরে না।
গোরুমারার সব চেয়ে কাছের বনবাংলো চাপড়ামারি। গোরুমারার যেমন গোপালদা, চাপড়ামারির তেমন ছিলেন বিশুদা। রসনা জগতে উত্তরবঙ্গের সেরা উপহার বোরোলি মাছ। হলংয়ে বেড়াতে গেলে জ্যোতি বসুর মেনুতে বোরোলি মাছের ঝাল-চচ্চড়ি ছিল অপরিহার্য। সেই বিশুদা একবার খাইয়েছিলেন কালো জিরে, কাঁচা লঙ্কা, বেগুন দিয়ে বোরোলির পাতলা ঝোল। অমৃত। মুগ ডালের আধশুকনো খিচুড়ি, খাসির মাংস মাখো মাখো করে এবং পেঁয়াজ-লঙ্কা-টোম্যাটো দিয়ে রুই মাছ ভাজার মতো খাসা রান্না বিরামহীন ভাবে করে যাওয়া বিশুদাকে এক ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার তাঁর নিজের বাংলোয় নিয়ে গেলেন। তার পর বিশুদার আর বন বাংলোয় ফেরা হয়নি। চাপড়ামারিতে বিশুদার জায়গায় এখন সূর্যদা। তাঁর হাতের পাকা পোনার কালিয়া, নদীয়ারি চুনো মাছের চচ্চড়ি অতুলনীয়।
অধিকাংশ বন বাংলোর কাঠামো, সিঁড়ি, মেঝে ও অনেক দেওয়ালই কাঠের। সেই কাঠ এবং চার দিকের গাছপালা, মাটি ও বিশুদ্ধ মিলেমিশে যে বুনো গন্ধ তৈরি করে, তাতে যে কোনও সুখাদ্যে যোগ হয় মাদকতা। শীতে বন বাংলোয় থাকার হিড়িক লেগে থাকে। আবার এই ঠান্ডার মরসুমেই বন বাংলোর খাবারের স্বাদ যেন আরও জম্পেশ। গয়েরকাটার খুঁটিমারি বাংলোয় রয়েছেন সন্দীপদা। ডোরাকাটা, দেশি ট্যাংরার পেঁয়াজকলি-বেগুন-আলু দিয়ে রাঁধা হাল্কা ঝোলের এর অসামান্য পদ। আলু দিয়ে দেশি মোরগের লাল ঝোল রান্নাতেও সন্দীপদা এক নম্বরে থাকবেন। সন্দীপদার হাতে এগ পকোড়া, চিকেন পকোড়াও লা-জবাব।
বন বাংলোর স্ন্যাক্স বলতে মূলত আমিষ-নিরামিষ পকোড়াই। কিন্তু নদিয়ার বেথুয়াডহরি বন বাংলোয় কড়া পানীয়ের সাহচর্যে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস মেলায় চমকে উঠেছিলাম। সেখানে কিন্তু রান্নার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় এক বয়স্ক মহিলা। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইসে চাপড়ামারির সূর্যদার ব্যুৎপত্তিও অবশ্য কিছু কম নয়। আবার বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত, দেড়শো বছরেরও বেশী পুরোনো রায়ডাক বাংলোর প্রবীণ কুক কেশব দাস বানাতে পারেন ধনেপাতার এক অদ্ভুত পকোড়া। স্বাদ-রহস্য লুকিয়ে ছিল বেসনের গোলায় মেশানো আদা কুচি ও দানা ছাড়া কাঁচালঙ্কা কুচির মধ্যে।
বন বাংলোয় রান্না খাবারের স্বাদ অনন্যসাধারণ হওয়ার রসায়ন তার বাসন-কোসনেও। সবই উঁচু মানের, চিনেমাটির তৈরি। সাজানো ও পরিবেশনের সঠিক আদবকায়দাতেও কিন্তু খাবারের স্বাদ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। একবার ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারের অতিথি হয়ে চিলাপাতার বন বাংলোয় তিন বন্ধুকে নিয়ে রাত ৯টায় পৌঁছে সমস্যায় পড়লাম। কোনও কারণে ভুল বোঝাবুঝিতে রেঞ্জ অফিসার ও কুক ভেবেছেন, আমরা ডিনার করেই ঢুকব। শেষমেশ বহু চেষ্টাচরিত্রের পর ওই রাতে গরম ভাতের সঙ্গে জুটেছিল ডাল, আলুভাজা ও ডিমভাজা। কিন্তু যে ভাবে পরিবেশন করা হল, বহু বড় রেস্তোরাঁতেও সেই ভঙ্গিতে পোলাও-কোফতা-কোর্মা-কাবাব দেওয়া হয় না।