বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

উদয়শঙ্কর – নব-উচ্চাঙ্গ নৃত্যধারার পুরোধা 

December 8, 2020 | 2 min read

উদয়শঙ্করের জন্ম হয়েছিল রাজপুতনার মেওয়ার অঞ্চলে উদয়পুরে ১৯০০ সালের ৮ ডিসেম্বর। নৃত্যশিল্পে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত ছিলেন না এবং কদাচিৎ ‘গুরুমুখী’ হয়েছিলেন। রাশিয়ার নৃত্যশিল্পী আনা পাভলোভা ভারতের অজন্তার দেয়ালচিত্রে (Mural Painting) ও ইলোরা মন্দিরে পাথরের ভাস্কর্যের মধ্যে নৃত্যের গ্রীবাভঙ্গি দেখে সেগুলো কপি করাতে চান। সেজন্যে রোদেনস্টাইনের দ্বারস্থ হলে তিনি উদয়শঙ্করকে এ-দায়িত্ব দেন। 

উদয়শঙ্করের হাতে এই নৃত্যভঙ্গিযুক্ত দেয়ালচিত্র ও পাথরখোদাই জীবন্ত হয়ে ওঠে। পাভলোভা উদয়শঙ্করকে ওই নৃত্যভঙ্গির অনুসরণে নাচের মুদ্রা সৃষ্টি করতে প্রাণিত করেন। এরকম প্রেরণা থেকে সৃষ্টি হয় হিন্দু বিবাহ ও রাধাকৃষ্ণ নৃত্যনাট্যদ্বয়। রাধাকৃষ্ণ নৃত্যে উদয়শঙ্কর কৃষ্ণ আর পাভলোভা রাধার ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করেন। এরপর পাভলোভার দলে যোগ দিয়ে তিনি কানাডা ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এভাবে শুরু হয় উদয়শঙ্করের নৃত্যচর্চা ও নৃত্য নিয়ে পৃথিবী পরিক্রমা।

উদয়শঙ্কর যখন নৃত্য বিষয়ে কাজ শুরু করেন তখন স্বদেশে ও বিদেশে তাঁর সমসাময়িক শিল্পী ছিলেন রুক্সিনী (রুক্ষ্মিণী) দেবী,  অরুণ ডেল (১৯০৪-৮৬), মদন মেনকা (১৮৯৯-১৯৪৭), ই. কৃষ্ণ আয়ার (১৮৯৭-১৯৬৮), রামগোপাল (১৯১২-?), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি বল্লাঠন নারায়ণ মেনন (১৮৭৫-১৯৫৭)। আর পাশ্চাত্যে ছিলেন রুথ সেল্ট ডেনিস, টেড শোয়াল, লা মেরি, ইনোকা, মেরি উইংম্যান, রজনী দেবী প্রমুখ। 

এঁদের নৃত্যধারার পাশাপাশি থেকে উদয়শঙ্কর সমসাময়িক নৃত্যশিল্পীদের চিরায়ত বা ধ্রুপদী নৃত্যের প্রতি আগ্রহী না হয়ে নতুন শাস্ত্রীয় ধারায় পাশ্চাত্যের দৃষ্টি ভারতের চিরায়ত নৃত্যের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করেন। কেননা তাঁর ভারতবোধ এত গভীর ছিল যে, ভিনদেশি কোনো কিছু তাঁর নাচের বিষয় হয়ে ওঠেনি। দেশি পোশাকের প্রতি তাঁর আগ্রহ থাকায় তিনিধুতি-পাঞ্জাবি পরে Grand Hotel বা অন্য কোনো প্রথম শ্রেণির হোটেলে যেতে এতটুকু সংকোচ বোধ করতেন না। এ-ব্যাপারে কোনো বাধা, বিশেষ করে পুলিশি বাধা তিনি কদাচিৎ গ্রাহ্য করতেন। এই Anti-British বোধ আসলে Anti ছিল না; বরং দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন বলে অনেক বেশি ভারতীয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

তিনি নতুন নৃত্য সৃষ্টির পাশাপাশি যন্ত্রী ও বাদ্যকারদের জন্য তৈরি করেন নজরকাড়া পোশাক। তিনি ও এলিস বোনার মিলে অজন্তা ও ইলোরার ভাস্কর্য নিয়ে তৈরি করেন অন্যরকম Costume। নবগঠিত দল নিয়ে তিনি পরিভ্রমণ করেন গোটা ইউরোপ, অর্থাৎ ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশ। এছাড়া ভারতের প্রধান প্রধান সব শহরে তিনি নৃত্য পরিবেশন করেন।

উদয়শঙ্কর ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে যান। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন মিস ব্রোনার ও খ্যাতনামা অনুষ্ঠান পরিচালক হরেন ঘোষ। সে-যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ আশ্রমে না থাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে দেখা হয়েছিল ১৯৩৩ সালের ৫ থেকে ৭ জুলাইয়ের মধ্যে। এ-সময় হরেন ঘোষের ব্যবস্থাপনায় কলকাতা মাদান থিয়েটারে উদয়শঙ্করের নৃত্য দেখতে আসা কবিকে প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ মালা পরিয়ে বরণ করে। 

উদয়শঙ্করের নৃত্য দেখে বিমুগ্ধ কবি তাঁর গলার মালাটি উদয়শঙ্করের গলায় পরিয়ে দেন। এরপর বর্ষামঙ্গল উৎসবের চারদিন পর ১২ জুলাই উদয়শঙ্কর শান্তিনিকেতনে যান। সেখানে তিনি ইন্দ্রনৃত্য পরিবেশন করে কবির আশীর্বাদ লাভ করেননি শুধু, কবি উদয়শঙ্করের উদ্দেশে একটি অভিনন্দনপত্র রচনা করেন। অভিনন্দনপত্রটি পরে প্রবাসীতে (ভাদ্র ১৩৪০ সংখ্যায়) প্রকাশিত হয়। 

রবীন্দ্রনাথের কামনা উদয়শঙ্করের জীবনে বাস্তবায়িত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদধন্য উদয়শঙ্কর আলমোড়ায় সিমতোলার পাহাড়ে ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘উদয়শঙ্কর কালচার সেন্টার’। সেখানে জড়ো হন ভারতের শ্রেষ্ঠ সংগীত গুণিজন। উদয়শঙ্করের নৃত্যধারাকে সমসাময়িক সমালোচকেরা Oriental Dance বা প্রাচ্য নৃত্য বলতে চাইলেও আসলে তাঁর নৃত্যধারা গড়ে উঠেছে Oriental ও Occidental ধারার সমন্বয়ে। যাকে বলা হয় Neo-Classical বা নব-উচ্চাঙ্গধারা। 

একদিকে যেমন Traditional বা ঐতিহ্যবাহী পৌরাণিক কাহিনীকে নৃত্যের উপজীব্য বা বিষয়সূচীতে (Item) স্থান দিয়েছেন, তেমনি অতি আধুনিক যান্ত্রিক ও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের যুগের বিষয়বস্তুও তাঁকে ভাবিত করেছে। আবার এ-ও দেখা গেছে যে, দেশে নতুন কোন কিছু ঘটেছে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছে, তার উপরও তিনি নৃত্য পরিকল্পনা করেছেন।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#uday shankar

আরো দেখুন