ফিরে দেখা – ধনঞ্জয়ের ফাঁসি ও সমাজের আত্মতুষ্টি
ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে নিশ্চয়ই আমরা কেউ ভুলে যাইনি। ধর্ষণে অভিযুক্ত দেশের শেষ আসামি যাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
৫ই মার্চ ১৯৯০, বিকেলে এ খুন করে ধর্ষণ করা হয় হেতাল পারেখকে। ১৪ বছরের এক গুজরাটি কিশোরি। সেদিন আইসিএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফিরছিল হেতাল। খুনের আগে তাকে শেষবারের জন্যে দেখে তারই এক প্রতিবেশী। ধনঞ্জয় ছিলেন সেই ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ান। এই ঘটনার একদিন পরেই নিজের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ধনঞ্জয়কে।
দোষী প্রমাণিত হতেই কারাদন্ড। গোটা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে এই ঘটনায়। সংবাদমাধ্যম এবং পুলিশ প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে একে অপরের। তারপর বহু টানাপোড়েনের পর ১৪ই আগস্ট, ২০০৪ সালে ১৪ বছরের কারাযাপনের পর ফাঁসি হয় ধনঞ্জয়ের।
কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল এই ফাঁসি? অনেকেই এই ফাঁসিকে সাংবিধানিক খুন বলেছেন। ধনঞ্জয়ের এই ফাঁসির ঘটনার রহস্য আজও অধরা। বিতর্ক আজও পিছু ছাড়েনি এই কেসের।
প্রথম বিতর্ক হয় হেতালের বয়স নিয়ে। অনেকেই বলে থাকেন ১৪ নয়, ১৮ বছর বয়সী ছিল হেতাল। কারণ সেদিন সে বোর্ডের পরীক্ষা দিয়ে ফিরছিল। যা ১৮ বছর বয়সে দেওয়াটাই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়, হেতালকে কি সত্যিই ধর্ষণ করা হয়েছিল? হেতালের বয়স যদি সত্যিই ১৮ হয় তাহলে সম্মতি সূচক যৌনতার ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চিহ্ন পাওয়া গেছে হেতালের শরীরে। যদি সে সত্যিই ১৪ বছরের ছিল তাকে আইনের চোখে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবেই দেখা হবে, কিন্তু তার বয়স যদি ১৮ হয় তাহলে এই সম্ভবনার কি ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ পাওয়া উচিৎ ছিল না? এনিয়েও উঠেছিল বিস্তর বিতর্কের ঝড়।
অনেকের মতেই এটি একটি ‘অনার কিলিং’ এর ঘটনা। যা ঢাকতে বলির পাঁঠা বানানো হয় নির্দোষ, গরীব ধনঞ্জয়কে।
এবার আসা যাক অন্য একটি সম্ভাবনায়। যদি ধনঞ্জয়ই দোষী হয়ে থাকে। যদি হেতালকে সেই ধর্ষণ করে থাকে। আমাদের দেশের সরবোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ড। এই যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মেয়াদ মোটামোটি ১৪ বছর। ধনঞ্জয়ের ফাঁসির আগে সে ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়ে ফেলেইছিল। তার মানে তার সরবচ্চো সাজা হয়েই গিয়েছিল। তাহলে কি করে তার আবার ফাঁসি হল? একই দোষের দুই স্বাস্তি কি সত্যিই বাঞ্ছনীয়?
গুজরাটি সমাজের ভোট বাঁচানোর দায়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী ধনঞ্জয়ের ফাঁসির দাবীতে রাস্তায় নামেন, সংবাদমাধ্যমগুলিও ফাঁসির পক্ষে সওয়াল করতে থাকে, পুলিশের গাফিলতি নিয়েও প্রশ্ন তুলতে থাকে। কতকটা চাপের মুখেই পুলিশ প্রশাসনকে তড়িঘড়ি ফাঁসির কাঠে ঝোলাতে হয় ধনঞ্জয়কে যথেষ্ট প্রমান ছাড়াই।
ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় ধনঞ্জয় গাইছিলেন ‘চালতে চালতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা কাভি আলবিদা না ক্যাহেনা’।
না! ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে আলবিদা করা যায়নি। এখনো অনেক প্রশ্নই দানা বেধে আছে আমাদের মনে। কতটা সাংবিধানিক ছিল এই সাংবিধানিক খুন?
আমরা কোন ভারডিক্ট দিচ্ছি না। শুধুই একটা প্রশ্ন রাখলাম। ভেবে দেখুন।