কবিতা কি আজও বেঁচে আছে?
আজ বিশ্ব কবিতা দিবস। একদিকে করোনা একদিকে দাঙ্গা, এর মাঝে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। ভবিষ্যতে কবিতা লেখা হবে না, একথা বলেছিল থিওডর অ্যাডর্নো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। বের্টোল্ট ব্রেখট বলেছিলেন যে অন্ধকার সময়ে গান হবে? কি গান হবে? তার উত্তরে উনিই লিখেছিলেন যে অন্ধকার সময়ে অন্ধকারের গান হবে। এরকম একটা প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে কি কবিতা বেঁচে আছে এবং থাকবে? সেই বিশ্বাসটা আছে?
কি বলছেন কবিরা? তাদের সাথে কথা বললেন দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুভজিৎ গুপ্ত
(উল্লেখযোগ্য কবিতা গ্রন্থঃ ঘুমন্ত লাটাই, ঘুমিয়ে পড়া পতাকা সংগ্রহ, কথাবার্তার বোবাছায়া, তোমাকেই দিদিমণি, নীলরঙের বেঁচে থাকা, পাখিদের আহিরভৈরিব প্রমুখ। সম্পাদিত পত্রিকাঃ, কবিসম্মেলন। সান্ধ্যভাষা।)
কিছু লোক খেলতে পারে, খেলোয়াড় হয়, কিছু লোক রাজনীতি করতে পারে, রাজনীতিবিদ হয়, নেতৃত্ব দেয়, কিছু লোক সংসার করে, বাজার করে, কিছু লোক রোজ ট্রেনে বাসে ঝুলে ঝুলে অফিসে যায়, এরা সবাই কথা বলে। অটোওয়ালা খিস্তি দেয়, কন্ডাক্টর আসতে লেডিজ বলে, কিছু মানুষ এর কোনোটা করে না। কিন্তু, তাঁদের কথা বলতে ইচ্ছে করে, তারা কবিতা লেখে। এই মানুষগুলোর কথা বলাটা কোনোদিন বন্ধ হবে না। সেজন্য কবিতাও কখনো বন্ধ হবে না।
কবিতা ব্যক্তিগত আবেগ অবশ্যই, তার সঙ্গে একটা মানুষ যে কবিতা লেখে, সে রক্তমাংসের মানুষ হয়, নির্জন থেকে আরও নির্জনে চলে যেতে পারে, সেই মানুষটা জানে যে অন্ধকার সময়ে অন্ধকারের কথা মানুষ লেখে। কিন্তু, আলোর সময়েও অন্ধকার ছিঁড়ে দেওয়ার চরম ধারাবাহিকতাটা খারাপ ভাবে জড়িয়ে না নিলে অন্ধকারের খনি থেকে হঠাৎ করে কেউ বেরিয়ে আসেনা।
অভীক মজুমদার
(বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক। যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সিলেবাস কমিটির চেয়ারপার্সন।)
বিশ্বের ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে আমাদের গ্রহের উন্নয়ন শুধু যে ভয়াবহতা দেখছে তা তো নয়, বিশ্বের ইতিহাসে বারংবার মানবিকতার বিরুদ্ধে ভয়াবহতা একধরনের আক্রমণ করেছে। তার নানারকমের চেহারা ছিল, নানারকমের বহুমুখ ছিল, নানারকমের আক্রমণের ধরণ ছিল, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আদিযুগ থেকে আজ অবধি কবিতাকে রোখা যায়নি। কবিতা এমন একটা মানবিক এবং এক ধরনের নির্ভীক উচ্চারণ যে উচ্চারণটা ভয়বহতার সময় বরং অনেক সূচীমুখ হয়ে ব্যক্ত হয়।
অন্ধকারের দিনগুলিতে কি গান থাকবে না? থাকবে অন্ধকারের গান। কবিদের কথাও যদি ধরা যায়, কত কবি ভয়াবহতার সামনে দাঁড়িয়েছেন, মারা গেছেন, খুন হয়েছেন, তবেই তো কবিতা পাওয়া গেছে। অথবা কবিতা লিখতে লিখতে মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। সমকাল যত টুঁটি চেপে ধরে রাখতে চাইবে যত জোরে, কবি তত জোরেই তাঁর উচ্চারণগুলি কবিতায় ফুটিয়ে তুলবেন।
মুকুট ভট্টাচার্য
(প্রকাশিত কবিতার বইঃ সোম। নানা নামী পত্রিকায় লিখেছেন ও সম্পাদনার কাজে জড়িয়ে থেকেছেন।)
কবিতা দিবসের কোনও সেরকম স্বার্থকতা নেই। কিন্তু, কবিতা বিষয়টিকে ফিরিয়ে আনার খুব প্রয়োজন আছে। মার্ক্স লিখেছিলেন উনিশ শতকের বিপ্লব তার কন্টেন্টটা খুঁজে পাবে কবিতার মধ্যে। অ্যারিস্টটলের একটা বিখ্যাত কথা আছে, ইতিহাসের চাইতে কাব্য, হিস্টিরিয়ার চাইতে পোয়েসিস যা জ্ঞানের উৎকৃষ্ট পথ।
এই যে যুক্তিবাদ দিয়ে চারদিক ঘিরে ফেলা হচ্ছে, মানুষ খুন করারও যুক্তি আছে, এর মাঝে কবিতাই বারবার কল্পনাকে অভিবাদন জানায়। কল্পনা তার কাছে একটা বিশেষ বস্তু। কল্পনাই শেষ পর্যন্ত অপরকে নিজের কাছে আহ্বান করে আনে, যুক্তি নয়। যুক্তি উন্নাসিক , কল্পনা নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে অপরা শক্তির জন্য। অপর যাতে আমার ওপর ভড় করে। গোটা বিদ্যাটার একটাই লক্ষ্য হল যাতে কল্পনা জাগ্রত হয়। সেখানে কবিতার ভূমিকা চিরকালীন।