কলকাতা বিভাগে ফিরে যান

এবার ফাঁকা কলকাতার সান্তার ঝুলিও

December 25, 2020 | 2 min read

ছবি : সংগৃহীত

৩, বেডফোর্ড লেন। রিপন স্ট্রিটের(Ripon Street) এঁদো গলিঘুঁজিতে ইটের গা বের করা বাড়িটা আসলে বুড়ো সান্তার অন্যতম ডেরা। ভাঙা গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ির নীচ দিয়ে ডানদিকে ঘুরে দুটো দরজা পেরলেই সেই মায়ার জগৎ!
চৌকাঠে দাঁড়িয়ে যে মানুষটির সঙ্গে আলাপ হল, তিনিই সান্তা(Santa Claus)। পোশাকি নাম সেলিম আহমেদ খান(Salim Ahmed Khan)। সাদা চাপদাড়ি, কলপ করা চুল, পরনে জামা-প্যান্ট। দু’টি ঘরের ভূগোলে দৈন্যের ছাপ স্পষ্ট। ডাঁই করে রাখা চিরপরিচিত লাল পোশাক-টুপি। ফি বছর বড়দিনে এই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন আরও কত সান্তা ক্লজ। ভেঙে যায় ধর্মের বেড়াজাল।
করোনা-লকডাউন জর্জর সময়ে এবার শহরে দেখাই মিলছে না সান্তার। বড় অনুষ্ঠান-পার্টি-জমায়েত যে নিষিদ্ধ। কোথায় গেলেন লাল পোশাক-সাদা দাড়ির মানুষগুলো? উত্তর জানা নেই সান্তা সেলিমের। তাঁর ঝুলিও ফাঁকা। বললেন, ‘সবই ঠিক চলছিল। কোথা থেকে যে চলে এল করোনা! লকডাউন(Lockdown) লেগে গেল। তিন মাস পুরো বন্ধ। এখনও তো আনলকের মতোই চলছে। একটাও কাজ নেই।’ তাঁদের ঝুলি থেকে বেরনো নিপাট আনন্দই যে এবার হয়ে যেতে পারে সংক্রামক! পার্টি বা দোকানের সামনে সান্তা দাঁড়ালেই হামলে পড়বে ভিড়। আর করোনা রুখতে ভিড় করাই মানা। তাই বড়দিনে পার্টি হলেও সেলিমের কাজ বন্ধ। দুঃখের সুর ভেসে এল, ‘এমনিতেই দুনিয়ায় হাসি খুব কম। এমন একটা কাজ বের করলাম, যাতে হাসি ছড়াতে পারি। কিন্তু এই ভাইরাসে সব মাটি করে দিল।’
ক্রিসমাসের(Christmas) সময় অন্তত পাঁচশো জায়গা থেকে সান্তার বরাত আসে সেলিমের কাছে। মহল্লা থেকে ছেলেদের পাঠান। দিনে ৩০-৪০ জায়গায় কাজ। তিন ঘণ্টায় হাতে আসে ৫০০ টাকা। এবছর বরাত ছিল। কিন্তু একজনকেও পাঠানো যায়নি। অন্যবার এই পর্বের উপার্জন দিয়ে চলে পরের ছ’মাস। এবার ন’মাস ধরে রেশনের চাল আর জমানো পুঁজিই ভরসা। হাত খালি হচ্ছে। কর্জও হয়েছে খানিক। পাড়ায় ক্যারম আর নাতি-নাতনিদের নিয়েই কাটে সকাল থেকে রাত। এভাবে আর কতদিন চলবে? জানেন না সেলিম। দোয়া করছেন আল্লার কাছে। সান্তার কাছেও। 
ডিসেম্বরে সান্তা হলেও বছরের অন্য সময় সেলিম ভাইয়ের চাহিদা বিস্তর। চ্যাপলিন, মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, ছোটা ভীম, মোটু-পাতলু, ডোরেমন… আরও কত কী সাজেন, সাজান। পাঁচতারা হোটেল থেকে শুরু করে অভিজাত ক্লাব, বিয়েশাদি, জন্মদিন—সর্বত্র। বিখ্যাতদের সঙ্গে ছবি ভর্তি বাড়িতে। পাড়ায় একনামে চেনে সবাই। সঙ্গে জুড়ে দেয়, জোকারওয়ালা পদবি। কিন্তু এবার যে বিধি বাম। 
কবে থেকে এই পেশায়, শুরু হল সেই কিসসাও। স্মৃতিধূসর চোখ, আবেগী চেতনা শোনাল, ‘পার্টি-বিয়ে ইত্যাদি অনুষ্ঠান সাজানোর খানদানি ব্যবসা আমাদের। সেই ’৯২ সালে পুজোর আগে লিন্ডসে স্ট্রিটে একটা কাপড়ের দোকান সাজানোর কাজ দিয়েছিলেন ওবেরয় গ্র্যান্ডের ব্যাঙ্কোয়েট ম্যানেজার। বহুত খেটে সাজালাম। তারপরও দোকানের মালিক বলে কি না, এমন কিছু চাই যাতে ভিড় লেগে যায়। মাথায় রাগ চড়ে গিয়েছিল জানেন! বললাম, এক কাম কিজিয়ে! দোকানের বাইরে জোকার বসান, ভিড় আমদানি হবেই। ওমনি লোকটাও ঝুলে বসল, জোকার এনে দাও। বলে কি না, আপনিই পারবেন।’ পেরেছিলেন? ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল, ‘হ্যাঁ, বাড়ি এসে দুই ভাই আর ভাতিজাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেলাম। কে জানত, আমার প্ল্যান ধামাকা হয়ে যাবে। বড় কোম্পানি থেকে অর্ডার আসতে লাগল।’ আর তখনই আইডিয়াটা বিদ্যুতের গতিতে খেলে গেল তরুণ সেলিমের মাথায়। এটাই তো হতে পারে উপার্জনের রাস্তা! ব্যস, শুরু হল জোকারের কামাল। নামও বদলে গেল, সেলিম জোকারওয়ালা।
সেই ঘটনার ক’মাস পরেই ছিল বড়দিন। হয়ে উঠলেন সান্তা ক্লজ। সেই শুরু পথ চলা। এখন বাবার জুতোয় পা গলিয়েছেন ছেলে সাবিরও। চাপা গর্ব রয়েছে আব্বার জন্য।
অদূরে মসজিদ থেকে ভেসে এল আজানের সুর। বিদায় নেওয়ার পালা সেলিম সান্তারও। আচমকা তাঁর গলায় উঠে এল রাজনীতি। নিচু স্বরে বললেন, বিজেপি বলছে জানুয়ারি থেকে সিএএ…। কী যে হবে এবার? উত্তর খুঁজছিলেন হয়তো। ফোনটা বেজে উঠল ঠিক তখনই, ‘জিনা ইয়াহাঁ, মরনা ইয়াহাঁ, ইসকে সিওয়া যানা কাহাঁ…।’

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Kolkata, #Santa Claus

আরো দেখুন