রাজনীতি থেকে দাম্পত্য, বিজেপি থেকে তৃণমূল – অকপট সুজাতা
সুজাতা মণ্ডল খাঁ। রাজ্য রাজনীতিতে এক পরিচিত নাম। বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁয়ের স্ত্রী ছাড়াও ওনার পরিচয় এক দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সৌমিত্রর হয়ে প্রচার করে সাড়া দিয়েছিলেন। সম্প্রতি বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়ে শোরগোল ফেলেছেন। দলবদল, স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে খোলামেলা সাক্ষাৎকার দিলেন দৃষ্টিভঙ্গিকে।
প্রশ্ন: সুজাতা মণ্ডল নাকি মণ্ডল খাঁ – আপনি কোন পরিচয়ে মানুষের কাছে আসতে চান?
সুজাতা: দেখুন প্রথমে আমার পরিচয়টা হচ্ছে জন্মগতভাবে সুজাতা মণ্ডল (Sujata Mondal)। ঠিক আছে? তো সেই পরিচয়টাতেই পরিচিত হতে চাই। আর আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন আমার মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গি, তাহলে আমি বলবো সারা পৃথিবীর সমস্ত মেয়ের পরিচয়টা তাঁর নামে আর কর্মে হোক। এবং সেখানে আমি যদি শুধু সুজাতা নামে পরিচিত হতে পারি গোটা বিশ্বে, তাহলে আমি সেটাতেই সবথেকে বেশি খুশি হব আর আমার পরিচয়টা আমার কর্ম দিয়ে মানুষ বিচার করুক। আমার কাজ মানুষের মনে প্রভাব ফেলুক যাতে পদবীটা বিবেচ্যই হবে না। আর মেয়েরা কতদিন স্বামীর পদবীর আড়ালে নিজেদেরকে ঢাকতে বাধ্য হবে? ২০২১-এর এই যুগে এসে এবার এটাই হোক না, মেয়েদের পরিচয়টা তাঁর নামে আর কর্মে হোক। সেখানে পদবী যেন কোনও বিড়ম্বনার কারণ না হয়।
প্রশ্ন: কিছুদিন আগেই তো আপনি শুভেন্দু অধিকারীকে কার্যত চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। সেই শুভেন্দু অধিকারী যার নামে প্রচুর লোক জড় হয়েছেন বলে দাবি করেছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এখন তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তো আপনি যে এই চ্যালেঞ্জটা করছেন শুভেন্দু বাবুকে, আপনার কর্মদক্ষতা, মানে কোথা থেকে সেই আত্মবিশ্বাসটা পাচ্ছেন? আপনার তো রাজনীতিতে আসা এই কিছুদিন আগে।
সুজাতা: দেখুন যদি সততা থাকে, লড়াই থাকে আর মনের মধ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকে, সেখানে বয়স বা অভিজ্ঞতাটা সবক্ষেত্রে বিচার্য হয় না। কারণ, আপনারা জানেন তাহলে তো বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) বিরুদ্ধে লড়াই করবার পশ্চিমবঙ্গে কোনও ফেসই নেই। কারণ, তাঁর লড়াইয়ের বয়সটাই হচ্ছে ৫০ বছর। আপনারা জানেন উনি ১৬ বছর বয়সে উনি কিশোরী থেকে লড়াই শুরু করেছিলেন জীবনের লড়াই, দারিদ্র্যর বিরুদ্ধে লড়াই আর আজকে ওনার বয়স ৬৬র কোঠায়, ৬৫+। তাহলে সেইদিক দিয়ে দেখতে গেলে যেসব চুনোপুঁটিরা তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করার স্বপ্ন দেখছে সেটা কোথাও মনে হচ্ছে না দুঃস্বপ্ন? বোকা বোকা ব্যাপার।
তাই সেখানে আমার মনে হয় লড়াই করার জন্য মানসিকতার দরকার হয়, সততা দরকার হয়, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দরকার হয় আর দৃষ্টিভঙ্গি দরকার হয়। আমি সেখানেই শক্তি পাই আর সেই শক্তিটা আমাকে জনগণ যোগায় আর আমার লড়াই যোগায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee) আশীর্বাদ আছে মাথার ওপর। এর ভরসাতেই আমি কার সাথে আমি বয়সে কার থেকে অর্ধেক, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় কার কাছে হাঁটুর বয়সী, এগুলো আমার কাছে বিচার করেনা। আমি আমার লড়াই মানুষের জন্য অনেস্টির সাথে লড়ে যাবো।
প্রশ্ন: আপনি বলছেন লড়াই হবে মাঠে ময়দানে মানুষের জন্য। কিন্তু, এ লড়াই তো আপনার গৃহদাহ করল, আমরা যা দেখলাম বিগত কয়েকদিনে। সৌমিত্রবাবু প্রেস কনফারেন্স করেছেন সেখানে আপনাদের ব্যক্তিগত বিষয় এসেছে। উনি ভীষণ কাঁদো কাঁদো গলাতেই বলেছেন একপ্রকার। কিন্তু তারপরেই যখন ডিভোর্স নোটিশ পাঠালেন, তখন তাতে একগুচ্ছ অভিযোগের কথাও উঠে এসেছে সামনে। আপনার কী মনে হয় এটা নিয়ে? কোথাও কি উনি কোথাও চাপে পড়ে এগুলো করছেন? কী বলবেন আপনি?
সুজাতা: দেখুন জানিনা এটা ওনার নিজস্ব মানসিকতা থেকে করা না ওনার পারিবারিক চাপ না পলিটিক্যাল চাপ, মানে পার্টিগত চাপ। কারণ, তাঁর পার্টি যেখানে তিন তালাক রদ করে মুসলমান মেয়েদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, সেখানে আমার মত একটা রমণীকে যখন সেই দলের সাংসদ ওপেন প্রেস মিট করে ডিভোর্স বা তালাক দেয়, মানে সেটা কতটা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ম্যাচ করে সেটা আমি বলতে পারলাম না।
একটা কথা বলতে তাহলে পারি যে বিজেপি কা দিখানে কা দাঁত কুছ অউর হ্যায় অউর খানেকা দাঁত কুছ অউর হ্যায়। আজকে প্রায় ১০ দিন হতে যাচ্ছে আমার তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করার পর। আজ পর্যন্ত বিজেপির কোনও নেতানেত্রীকে দেখলাম না আমার পাশে দাঁড়াতে একজন মানুষ হিসেবে। দল তো পরে, রাজনীতি তো চলতেই থাকবে, কিন্তু, সেটা তো ঘরের বাইরের জিনিস। এটার এফেক্টটা ঘরের ভিতরে এসে কেন পড়বে?
আমি সবসময় জীবনে এটাই মনে করেছি বা বরাবর স্বামীকে সাথ দিয়েছি এই ভেবে যে স্বামীর পাশে স্ত্রীর থাকা দরকার। তাই সে যখন কংগ্রেস ছেড়েছিল, তখনও সাথ দিয়েছিলাম, সে যখন তৃণমূল ছেড়েছিল, মন থেকে মানতে পারেনি, তবুও সাথ দিয়েছিলাম স্বামীর খুশির জন্য। আর আজকে একটি মেয়ে সম্মানের সাথে বাঁচবে বলে যখন সে মনে করলো যে বিজেপি না করে তৃণমূল করবে, তখন আমার স্বামী জানিনা কেন আমার সাথ ছেড়ে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো। এত বড় পৃথিবীতে এক অল্পবয়সী নারীর হাতটা ছেড়ে দেওয়ার কেন প্রয়োজন মনে করলো। ১০ বছরের সম্পর্ক আমাদের। সাড়ে চার বছর আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম, তখন অগ্নি সাক্ষী করে সে কথা দিয়েছিল যে সারাটা জীবন সাথ নেভাবে। তো জানিনা কী এমন ভুল করে ফেললাম যে ভুলটা ২১শে ডিসেম্বর দুপুর ১টার আগে পর্যন্ত ছিলনা, আমি বিকেল পর্যন্ত ঘরের লক্ষ্মী ছিলাম, তার প্রেয়সী ছিলাম, আর তার পরের দিনই নোটিশে একগুচ্ছ অনেক অবান্তর আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের তির।
আমি যদি সত্যিই অতটাই খারাপ ছিলাম, তাহলে এতদিন কেন আমার বিরুদ্ধে সে অভিযোগগুলো আমার বিরুদ্ধে করা হয়নি, বা আমার বিরুদ্ধে কোনও কেস বা মামলা হয়নি? মানে আমার সত্যিই মনে হচ্ছে, যে দলত্যাগ কি ঘরভাঙার কারণ হতে পারে? তাহলে যখন ও দলত্যাগ করেছিল ২০১৯এ, তাহলে আমি যদি তখন সাথ ছেড়ে দিতাম, হয়তো আমি অনেক কিছু থেকে বেঁচে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি তো সাথ ছাড়িনি। মানে আজও কি মেয়েদেরকে প্রতি মুহূর্তে একটু মানুষ হিসেবে বাঁচার জন্য পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে? সবসময় কি মেয়েদেরকে তোমরা মেয়ে-এটা মনে করাতে হবে? নিজের পরিবারেই বলুন, বা সব ময়দানেই বলুন।
প্রশ্ন: বিজেপির হয়ে এতোদিন মাঠে ময়দানে কাজ করে এসেছে। কী পেয়েছেন দলটা থেকে? আর কী পাননি?
সুজাতা: পেয়েছিলাম মানুষের ভালোবাসা। দলের তরফ থেকে কিছুই পাইনি। যদি পদ একটা সম্মান হয় তাহলে সেই সম্মানও পাইনি। যদি কোন মেয়ের নিরাপত্তার দিক দিয়ে ভাবেন। যেখানে ওরা তোলাবাজ মাফিয়াকে নিরাপত্তা দিয়েছে। সেখানে একাকি একটা মেয়ে অতো জঙ্গলে সন্ত্রাসের মধ্যে লড়াই করে গেছি, আমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রয়োজন তাদের মনে হয়নি।
আমি দু’বছর ধরে বিজেপির (BJP) হয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করার পরেও তাদের মনে হয়নি যে সুজাতাকে সম্মান দেওয়া দরকার। যেখানে দু’মাস আগে দেখা যাচ্ছে অন্যান্য পেশায় যুক্ত অনেকে পেশায় অসফলতার জন্যে পার্টিতে এসেছেন তাদেরকে তারা যোগ্যতার থেকে বেশি সম্মান দিয়েছে। কিন্তু একজন লড়াকু স্বত্বাকে সম্মান দেওয়ার প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি মনে করেনি। দিনের শেষে আমরা সবাই সম্মান আর সুরক্ষা চাই।
প্রশ্ন: বিজেপিতে কি আপনি নিরাপত্তায় ভুগতেন?
সুজাতা: যে দলটায় নারী হয়ে লড়াই করেও নিরাপত্তা পাওয়া যায় না, সেখানে দুদিন আগে আসা তোলাবাজ, ধান্দাবাজ, মাফিয়াদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আমি তপশিলি জাতির মহিলা। এই দলটিকে কখনো দেখিনি কোন নীচু সম্প্রদায়ের মহিলাকে নেত্রী করে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। নিজের জন্যে শুধু বাঁচাটা তো স্বার্থপরতা।
আমি যেই সমাজ থেকে আসছি, সেখানকার নারীদের যন্ত্রণা, বঞ্চনার কাহিনী যদি আমি বিধানসভা বা লোকসভা পর্যন্ত নিয়ে যেতে না পারি! তাহলে বেঁচে থাকাটা স্বার্থপরতা হয়ে যায়। আমি অল্প বয়সেই আমার এই লড়াকু স্বত্বাকে আমি তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে কাজে লাগাতে চাই। আমার সিদ্ধান্তে আমাকে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাংলার মানুষ আশির্বাদ করেছেন।
প্রশ্ন: তৃণমূলের যোগদানের দুদিন আগেও সামাজিক মাধ্যমে আপনি বিজেপির হয়ে প্রচার করেছেন। কোন যাদুবলে দুদিনে আপনি দিদির আশ্রয়ে আসতে পারলেন?
সুজাতা: বিজেপিতে এখন যেই ভাড়া করা নেতারা আসছেন, তারা কতোটাই বা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের যন্ত্রণা বুঝতে পারবেন? মা- মেয়ের যেমন লড়াই হয়, সেরকম আমাদের মধ্যেও সাময়িক দূরত্ব এসেছিল। মায়ের কাছে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর তার কাছে গেলে মা বুকে জড়িয়ে নেন। রাজনীতিতে আমাদের মা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি যাওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- ও বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
আর একটা কথা ভেবে দেখলাম একজন নারীর যন্ত্রণা তিনি যতোটা বুঝবেন, ভাড়া করা নেতারা মোটেই বুঝবেন না। সুজাতা এক নারী হয়ে আরেক নারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করবে। তাই লড়াইতে সামিল হলাম। আপনাদের চ্যানেলের মাধ্যমে কথা দিচ্ছি ২০২১- এ বিজেপিকে ৫০- এ বেঁধে দেব। সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসকে তৃতীয়বারের জন্য আনার জন্যে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আবার মুখ্যমন্ত্রী করার জন্যে যতোটুকু পরিশ্রম, লড়াই করতে হয় ততোটাই করবে সুজাতা।
প্রশ্ন: দর্শকদের কি বলবেন?
সুজাতা: পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, বিশ্ববাসীর কাছে আমার তরফ থেকে রইল নববর্ষের একগুচ্ছ শুভেচ্ছা। সকলেই ভালো থাকুন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন এই বছর পৃথিবীকে করোনামুক্ত করেন। সকলকে এক আনন্দময় জীবন উপহার দেন। সবাই ভালো থাকবেন।