হচ্ছে টা কী? বিভাগে ফিরে যান

সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছেন নেতাজি: সুগত বসু

January 23, 2021 | 5 min read

আজ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মদিন। আজকের এই বিশেষ দিনে আমরা কথা বললাম ওনার পৌত্র ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক সুগত বসুর সাথে। দেখুন:

প্রশ্ন: আমরা জানি ২৩শে জানুয়ারি মানেই আমাদের সকলের কাছে, বাঙালির কাছে তো বটেই গোটা দেশের কাছেই একটা উৎসবের দিন। কারণ, নেতাজির জন্মদিন। আর এবার সেটা খুব আলাদা কারণ এবছর ১২৫তম জন্মদিবস।

একদম প্রথমেই আমরা সুগত বাবুর কাছে যে প্রশ্নটা রাখবো যে এই যে নেতাজির জন্মের ১২৫তম বছর শুরু হতে চলেছে, একটা মানুষ তাঁর কর্মকান্ড সারা দেশব্যাপী এভাবে আমরা জানি। নেতাজির পৌত্র হিসেবে আপনার চোখে নেতাজি ঠিক কী?

সুগত বসু: নেতাজি নিজে কিন্তু সবসময় বলতেন, তাঁর পরিবার এবং দেশ এক এবং সেই শিক্ষাই আমরা সবসময় পেয়েছি। আমার বাবা যখন জেল থেকে ছাড়া পেলেন সেপ্টেম্বর ১৯৪৫এ, আমার বাবা লাহোর সলিটারি কনসাইনমেন্টে ছিলেন। তারপর লালপুর জেলে ছিলেন। তখন তিনি একটা ধ্বনি শুনেছিলেন লাহোরে, বোস খানদান জিন্দাবাদ। তারপর উনি যখন লাহোর থেকে কলকাতা ফিরে এলেন, তখন তাঁর বাবা আমার ঠাকুরদা শরৎচন্দ্র বোস বলেছিলেন, এইসব ধ্বনি যেন তোমার মাথা ঘুরিয়ে না দেয়। তুমি মেডিক্যাল কলেজে পড়ছিলে, ফিরে যাও, করে পড়াশোনা শেষ করো, ডাক্তার হও। তারপরে দেশের কাজ করতেই পারো। কারণ, মনে রাখবে, এটা কিন্তু আর কিছুই নয়, এটা হচ্ছে সুভাষ এস রিফ্লেক্টেড গ্লোরি। 

সেই কথাটা আমার বাবা তাই আমাকে সবসময় বলেছেন। তাই আমি মনে করি আমাদের দেশের সকলেই নেতাজির পরিবার।

প্রশ্নঃ দেশের সকলেই নেতাজির পরিবার যেমন বলছেন আপনি, জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে যদি আসি, জাতীয়তাবাদ তো নেতাজির চোখে একদম অন্যরকম ছিল নিশ্চয়ই এবং আমরা ইতিহাসের পাতায় পড়েছি সেটা। কিন্তু আপনি যেটা বললেন পরিবারের মানুষ, তো তাঁর কিছু গল্প আপনিও শুনেছেন, সেইভাবে আপনার চোখে জাতীয়তাবাদ আসলে ঠিক কী ছিল নেতাজির কাছে?

সুগত বসু: আজকের দিনে আমরা দেখছি একটা খুব স্বার্থপর ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ, যার বিরোধীতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সব সময় করেছেন। তাঁর মনের মধ্যে ছিল, তাঁর কাজে দেখা গিয়েছে এক উদার দেশপ্রেম। আমি যখন বড় হচ্ছি, আমাদের বাবা মার কাছে থাকতে আসতেন নেতাজির সঙ্গে স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছেন এইরকম অনেকে। যেমন এসেছিলেন এস এ আয়ার, যিনি আজাদ হিন্দ সরকারের পাবলিসিটি মিনিস্টার ছিলেন, তিনি বসে আমাদের বলেছেন কীভাবে রাত্রে নেতাজি আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্র নিজে লিখেছিলেন। 

তারপরে আমাদের কাছে আসতেন আবিদ হাসান। যিনি একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী ছিলেন সেই ডুবোজাহাজের যাত্রায় ইউরোপ থেকে এশিয়া প্রায় তিনমাস। তিনি কে ছিলেন? তিনি একজন হায়াদ্রাবাদের মুসলমান। ইউরোপে ছাত্র ছিলেন। নেতাজির ডাকে আজাদ হিন্দ আন্দোলনে যোগদান করলেন এবং নেতাজি বলেছিলেন আমাদের একটি জাতীয় অভিবাদন ঠিক করতে হবে এবং আবিদ হাসানের সাহায্যেই কিন্তু আমাদের জয় হিন্দ ধ্বনি নেতাজি গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রচার করেছিলেন।

এই যে আমি যেরকম বললাম, আমার বাবা তো নিয়ে গেলেন কলকাতা থেকে। পেশাওয়ারে দাঁড়িয়েছিলেন ওঁর জন্য মিয়াঁ আকবর শা। সাবমেরিনে করে ইউরোপ থেকে এশিয়া এলেন আবিদ হাসান। তাই এবার আমরা নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর পক্ষ থেকে আবিদ হাসানকে পস্থ্যুমাসলি নেতাজির অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছি এবং তাঁর নিস ইসমত মেহেদি সেটা গ্রহণ করবেন ২৩শে জানুয়ারি।

তারপরে আপনি যদি ভেবে দেখেন যে আজাদ হিন্দ ফৌজ যে লড়াই করেছিল ইম্ফল আর কোহিমায় চলো দিল্লি ধ্বনি দিয়ে সেই প্রথম ডিভিশনের কমান্ডার কে ছিলেন? মহম্মদ জামান ইয়ানি।

গান্ধী ব্রিগেড যেটি লড়াই করেছিল ইম্ফলে, তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইনায়ক জান ইয়ানি। তারপরে যখন ইম্ফলের কাছে ময়রাতে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন হল, সেই কাজটি করেছিলেন সৌকত মালিক। নেতাজির শেষ বিমানযাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন হাবিবুর রেহমান। যখন আজাদ হিন্দ ফৌজের মেমোরিয়াল এত্মা ইত্তেফাক কুরবানি লেখা গড়ে উঠল সিঙ্গাপুরে, সেটা তৈরি করেছিলেন সিরিল জন ট্রেসি, আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন খুব ভালো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খৃষ্টান অফিসার। 

আর লালকেল্লায় যখন বিচার বসলো আজাদ হিন্দ ফৌজের সব অফিসারদের, তিনজনকে বেছে নিয়েছিল ইংরেজরা। তাদের নাম, প্রেম কুমার সেহগল, গুরবক্স সিং ধিলন এবং সাহনওয়াজ খান। এই নামগুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছে, যে নেতাজি আমাদের একমাত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা যিনি হিন্দু মুসলমান শিখ ঈশাই সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে আজাদির লড়াই লড়েছিলেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজে সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়া করতো, তারপরে তারা একসঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে রক্ত ঝরিয়েছিল, তাই সেই কথাটা আমাদের মনে রাখতে হবে। 

ঠিক যেরকম সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, একইভাবে বিভিন্ন ভাষাভাষির মানুষকে এক করেছিলেন। কারণ, ইংরেজদের, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে যারা ছিল, যাদের তিনি নিয়ে নিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজে, তারা অনেকেই ছিল পাঞ্জাব থেকে বা, নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স থেকে পাঞ্জাবী, পাঠান। কিন্তু, ইংরেজদের মতে বাঙালিরা বা, তামিলরা ছিল নন মার্শাল রেস। তারা তো আর সেই আর্মিতে বিশেষ ছিল না। কিন্তু, নেতাজি দেখলেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বেশিরভাগ ভারতীয়ই হচ্ছে দক্ষিণাত্যের। তামিলনাড়ু থেকে বা, অন্যান্য দক্ষিণের সমস্ত রাজ্য থেকে। তাদেরও তিনি নিয়ে নিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজে। তাই, একটা ঐক্য আর সাম্যের আদর্শ। 

সবচেয়ে বড় কথা তিনি মহিলাদের সমান অধিকার দিয়েছিলেন এবং তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজে একটি রানী অফ ঝাঁসি রেজিমেন্ট ছিল। এবং আমি ছোটবেলায় যখন বড় হচ্ছি, আমি লক্ষী সেহগলের কাছ থেকে বা, জানকী থেভারাথিরাপ্পনের কাছ থেকে সেইসব রানী অফ ঝাঁসি রেজিমেন্টের গল্প শুনেছি।

নেতাজি কিছুতেই রেঙ্গুন ছেড়ে যাবেন না যে যতক্ষণ না ব্যবস্থা হচ্ছে রানী অফ ঝাঁসি রেজিমেন্টের যারা সৈন্য, তারাও ফিরতে পারবে এবং একসঙ্গে হেঁটে ২৩ দিন তারা বার্মা থেকে থাইল্যান্ড রিট্রিট করেছিল। এইসব কাহিনী আমি তাদের মুখে শুনেছি। তাই কী ধরণের একটা উদার দেশপ্রেম ছিল, কোনও ভেদাভেদ ছিল না, সেইতাই কিন্তু আমাদের আজকে নতুন প্রজন্মকে শেখাতে হবে।  

প্রশ্নঃ নেতাজি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে দল বদল করেছিলেন। এখনো রাজ্য রাজনীতিতে নেতাদের দল বদল করতে দেখা যাচ্ছে। কোথাও কি মনে হয় রাজনীতিতে অবনমন হচ্ছে?

সুগত বসু: রাজনীতিতে সাংঘাতিক অবনমন হয়েছে। ১৯৩৯ সালে নেতাজির মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁর  অনুগামীদের সাথে মতপার্থক্য হয়। নেতাজির গান্ধীজির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল। উনি জয়ী হয়েছিলেন একটি কংগ্রেস সভাপতির নির্বাচনে গান্ধীজির প্রতিনিধিকে হারিয়ে। কিন্তু তারপর তিনি বলেছিলেন  দেশের সবচেয়ে মহান ব্যক্তিত্ব গান্ধীজি, আমি তাঁর বিশ্বাস অর্জন করতে চাই। গান্ধীজি নেতাজিকে বলেছিলেন ‘পেট্রিয়ট অফ পেট্রিয়টস’। নেতাজি গান্ধীজির উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “ফাদার অফ আওয়ার নেশন। ইন দিস হোলি ওয়ার ফর লিবারেশন। উই সিক ইওর ব্লেসিংস, অ্যান্ড গুড উইশেস”। 

১৯৪৫   থেকে ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮ অবধি যতবার মহাত্মা গান্ধী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সম্মন্ধে কিছু বলেছেন ওরকম প্রশংসা তিনি আর কারো করেননি। এমনকি তাঁর হত্যার আগের দিনও তিনি বলছেন আর কোন নেতা নেই যে মমত্ব এবং আনুগত্য অর্জন করতে পেরেছেন দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষের  কাছ থেকে। নেতাজির কথা মনে রেখে গান্ধীজি বলেছিলেন, “তোমাদের মন থেকে সমস্ত রকম সাম্প্রদায়িক সংকীর্নতা দূর করে দাও”। 

আজকের দিনে আমাদের গান্ধীজিকেও প্রয়োজন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসকেও প্রয়োজন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন সমান নাগরিকত্বে, সমান অধিকারে। পুরুষ, মহিলার সমান অধিকার। হিন্দু, মুসলিম, শিখ সকলের সমান অধিকার। সব ভাষাভাষি মানুষের সমান অধিকার। সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। নেতাজি দেখিয়ে দিয়েছিলেন নেতৃত্ব কাকে বলে। উনি কখনো কাউকে বলতেন না এমন ঝুঁকি নিতে যা তিনি নিজে নিতে প্রস্তুত নন। 

এই যে কলকাতা থেকে মহানিস্ক্রমণ আশি বছর আগে। তারপর প্রায় পায়ে হেঁটে পেশওয়ার থেকে কাবুল যাচ্ছেন আদিবাসী এলাকা দিয়ে। কতোবড় ঝুঁকি! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নব্বই দিন ধরে সাবমেরিনে করে ইউরোপ থেকে এশিয়া আসা। কতোটা ঝুঁকি। তাই তাঁর সঙ্গে যারা যুদ্ধ করতেন তাঁরা তাঁকে সম্পূর্নভাবে বিশ্বাস করতেন। আমি এরকম একটা ইন্টারভিউ মেহবুব আহমেদের সাথে ফিল্ম করছিলাম। তিনি ১৯৪৫ সালে নেতাজির মিলিটারি সেক্রেটারি ছিলেন। আমি যতবার ক্যামেরা চালানোর চেষ্টা করছি মেহবুব আহমেদ হাউ হাউ করে কাঁদছেন। 

উনি বললেন, “এতো দশক পেরিয়ে গেছে, কিন্তু নেতাজির কথা বলতে গেলে আমি আজও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি”। তিনি বললেন, “স্বাধীনতার পর কয়েক মাস আমার গান্ধীজির সাথে কাজ করবার সৌভাগ্য হয়েছিল”। তারপরে উনি ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস জয়েন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত উনি কানাডায় আমাদের অ্যাম্বাসেডর ছিলেন। বলেছিলেন, “অনেক বছর জহরলাল নেহেরুর সাথে কাজ করবার সুযোগ হয়েছিল। বাট দেয়ার ওয়াজ ওনলি ম্যান আই ওয়াজ প্রিপেয়ার্ড টু ডাই ফর। অ্যান্ড দ্যাট ওয়াজ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস”। 

তারা ওইরকম একজন নেতার ডাকে প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। সেই নেতৃত্বকে আজ মনে রাখার প্রয়োজন আছে।

প্রশ্ন: নেতাজির ১২৫ তম জন্ম বার্ষিকিকে কেন্দ্র করে একটি কমিটি তৈরি করেছে কেন্দ্র সরকার। যেখানে অভিনেতা, ক্রীড়া জগত, বাম- ডান সব দিকের মানুষকেই রাখা হয়েছে। সেখানে সুগত বসুর নাম নেই। কি বলবেন?

সুগত বসু: এই বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমার বাবাকে নেতাজি বলেছিলেন, আমার একটা কাজ করতে পারবে? সেই নেতাজির কাজ আমার বাবা শুধু যে ১৯৪১ সালে করেছিলেন তা তো নয়, ওনার মৃত্যুর দিন ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০০০ সাল অবধি করে গেছেন। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের যা শিক্ষা তা যেন নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। নেতাজির কাজের সঙ্গে আমি ছোটবেলা থেকে যুক্ত থেকেছি। নেতাজি সমগ্র রচনাবলী বাবার সাথে একসাথে প্রকাশ করেছি। আমার নেতাজিকে নিয়ে লেখা বই ‘হিজ ম্যাজেস্টি অপোনেন্ট- সুভাষ চন্দ্র বোস অ্যান্ড ইন্ডিয়াস স্ট্রাগল এগেন্সট এমপায়ার’ সেটা অনেকেই পড়েছেন। দেশনায়ক নামে তার বাংলা অনুবাদও রয়েছে। তাই আমি আমার মতো করে নেতাজির কাজ করে চলেছি। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোতে ৫০- এর দশক থেকে সম্মানের সাথে নেতাজির কাজ হয়ে আসছে।  

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Netaji Subhas Chandra Bose, #Sugata Bose

আরো দেখুন