পঙ্কজ মল্লিক – মহালয়াকে স্মরণীয় করে দিয়েছেন যিনি
বাঙালির রক্তের মধ্যে যদি কোনও সুর মিশে গিয়ে থাকে, সে সুর মহালয়ার। অন্য সময় রেডিওর সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক না থাকলেও বছরের একটি বিশেষ দিনে ভোরবেলা আজও বাঙালি বাড়ি থেকে ভেসে আসে মহিষাসুরমর্দিনীর চেনা সুর। পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও বাণীকুমারের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ স্মরণীয় করে দিয়েছে বাঙালির মহালয়া। যদিও ১৯৭৬ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে একটি নতুন মহালয়ার অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল। এই নতুন সংস্করণটির সুররচনা ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ভাষ্যরচনা করেছিলেন গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় ও পাঠ করেছিলেন উত্তমকুমার। শ্রোতারা একেবারেই গ্রহণ করেননি মহালয়ার এই নতুন রূপ। পরের বছর থেকেই আকাশবাণী ফিরে যায় চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে।
পঙ্কজকুমার মল্লিককে নিয়ে আরও কিছু স্মৃতিচারণ করেছেন রাজীব গুপ্ত। নিচে তারই কিছু অংশ তুলে দেওয়া হল:
রেডিওতে ৫০ বছরের কার্যকালে পঙ্কজ মল্লিক অগণ্য অবদান রেখে গিয়েছেন, তার মধ্যে দু’টি অনন্যসাধারণ— প্রতি রবিবার সকালের ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’ এবং মহালয়ার ভোরের বিখ্যাত অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। টানা প্রায় ৪৭ বছর একা তিনি সঙ্গীতশিক্ষার আসরের সঞ্চালনা ও পরিচালনা করেছেন। তখনও বাড়ির মেয়েদের বাইরে গিয়ে গান শেখার চল তেমন হয়নি, কিন্তু তাঁর অনুষ্ঠানের সূত্রে অজস্র নারী-পুরুষ উপকৃত হয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ আজ প্রথিতযশা শিল্পীও!
পঙ্কজ মল্লিকই (Pankaj Mullick) প্রথম ব্যক্তি যিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে সমাজের সব স্তরে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন এবং সঙ্গীতশিক্ষার আসর ছিল তার অন্যতম মাধ্যম। ১৯৩১ থেকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রচারিত হতে আরম্ভ করে, আজও তার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। বাণীকুমারের সৃষ্ট এবং রচিত এই বীথিটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠে সজ্জিত ও পঙ্কজ মল্লিকের সুরে অলঙ্কৃত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সম্পূর্ণ গ্রন্থনাটি তাঁর সুরে বাঁধা এমনকী, গোড়ার দিকের অনেক বছর সব ক’টি গানও তিনিই গাইতেন!
রেডিওতে কাজ করতে করতে প্রবাদপ্রতিম নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন প্রথম দিক থেকেই। ১৯৩১ সালে ‘চোরকাঁটা’ ও ‘চাষার মেয়ে’ নামে দু’টি নির্বাক চলচ্চিত্রে রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গে যৌথভাবে সুর দেন৷ তাঁর প্রথম একক কাজ প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’। নিউ থিয়েটার্সে থাকাকালীন অসংখ্য হিন্দি, উর্দু, তামিল ছবিতেও সুর দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার চালু হওয়ার পর ‘যাত্রিক’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ এবং ‘রাইকমল’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক বিবেচিত হন, ১৯৭২ সালে প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে দাদাসাহেব ফালকে সম্মান পান।
ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জন গণ মন’ তিনিই প্রথম গেয়ে রেকর্ড করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, জীবদ্দশায় যে সব গানে তিনি সুর করে যেতে পারবেন না, সেগুলিতে সুরযোজনার দায়িত্ব যেন পঙ্কজকুমার মল্লিক নেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবিগুরুর এই আশীর্বাদকে তিনি সব পুরস্কার ও সম্মানের ঊর্ধ্বে মনে করতেন।’’