রেলের দপ্তরে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজ্য বিজেপি নেতাদের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) ট্যুইট করতে পারেন, আর কলকাতা শহরের রেলের দপ্তরে এতবড় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় একজনও বিজেপি নেতা পৌঁছাতে পারেন না? যেখানে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতে তৃণমূল ছেড়ে এমন দু’জন নেতা যোগ দিয়েছেন, যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) দৌলতে রেলমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন।
সদ্য দলত্যাগী দিনেশ ত্রিবেদী কিংবা এখন বিজেপির অন্যতম সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায় সোমবার রাতে কোথায় ছিলেন এই প্রশ্নটা তা না তোলায় সমীচীন। সোমবার রাতে স্ট্র্যান্ড রোডে রেলের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখতে দেখতে তাই মনে হল কেন তিনি বার বার বলেন আসলে সব আসনে তিনিই প্রার্থী এবং লড়াইটা তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের।
কোন দূর্ঘটনার সঙ্গে রাজনীতিকে জড়ানোটা উচিৎ কাজ নয়। সোমবার রাতে রেলের দপ্তরের সামনে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে প্রশাসন চালাতে বা দূর্ঘটনার মোকাবিলায় কতটা অভিজ্ঞতা বা কতটা সংবেদনশীলতা কারা দেখাতে পারছেন। পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টে যখন আগুন লেগেছিল, তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু বিরোধী নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু ঘটনাস্থলে আগে পৌঁছাননি, সারাক্ষণ চেয়ার পেতে সামনে বসেছিলেন।
নিজেদের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে দেখতে সদা তৎপর বিজেপির নেতারা বা পশ্চিমবঙ্গে অন্য দলের নেতারা তাহলে তৃণমূল (Trinamool) নেত্রীর কাছ থেকে কি শিখলেন? বিশেষ করে যেখানে রেলের দপ্তরে আগুন লেগেছে এবং পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ছোট-বড়-মেজো-সেজো সব নেতারাই কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে ঘোরেন।
এমনিতে স্টিফেন কোর্ট বা কলকাতা (Kolkata) শহরের অন্য আগুনের ঘটনার সঙ্গে রেলের দপ্তরে আগুন এবং মৃত্যুর একটা মূলগত তফাৎ রয়েছে। সোমবার রাতে যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁরা মূলত উদ্ধারকর্মী। আগুন লাগার পরে যেটা প্রাথমিক কর্তব্য, অর্থাৎ লিফট ব্যবহার না করা, তাঁরা সেটাই করেছিলেন। অর্থাৎ লিফটে করে তাড়াতাড়ি তেরো তলায় পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পৌঁছে যাওয়ার পরবর্তী আগুনের ধাক্কায় তাঁরা ঝলসে যান। অর্থাৎ অন্যদের রক্ষা করতে গিয়ে বা তেরো তলায় যদি কেউ আটকে থাকেন, তাঁদের উদ্ধারের তড়িঘড়িতে দমকল বা আরপিএফের জওয়ান নিজেদের সুরক্ষার বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে সেটাই এই সাতজনের মৃত্যুর কারণ।
যে কোনও মৃত্যুই তো দু:খজনক বটেই, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে হয় কেন এই দুর্ঘটনা ঘটল। কলকাতার মতো একটা পুরানো শহরের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তার রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি। সোমবার রাতে রেলের দপ্তরে আগুন লাগার প্রাথমিক কারণ অনুমান করা হচ্ছে এয়ার কন্ডিশন মেশিন ফেটে কোনো ধরনের বিপর্যয়। অফিসটি রেলের ছিল, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের, তাহলে দুর্ঘটনার দায় কার? এই সব রাজনৈতিক কুটকাচালি সাতটা মানুষের প্রাণকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। পার্ক স্ট্রিটে স্টিফেন কোর্টের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের কারণও ছিল বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল বাড়ির মালিকদের অবৈধ নির্মাণ, যার ফলে আগুন লাগার পরে কিভাবে বেরিয়ে আসতে হবে, তাও অনেকের জানা ছিল না। স্টিফেন কোর্টের জানলা দিয়ে বা কার্নিশ বেয়ে নেমে আসার আকুল চেষ্টার ছবি এখনও এ শহরের সকলের স্মৃতিতে ফিকে হয়ে যায়নি। যাঁরা নেমে আসার বা আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের অনেককেই শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে প্রিয়জনদের কাছে ফিরতে হয়েছিল।
মঙ্গলবারও আবার কয়েকজন দমকল কর্মী বা আরপিএফের জওয়ান অন্যের কাঁধে চেপে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু আমরা মানে কলকাতাবাসী কতটা শিখবো? আদৌ কি শিখবো? এক একটা দুর্ঘটনা তো আসলে দেখিয়ে দিয়ে যায় আমাদের লোভ, অসর্তকতা এবং নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখানোর প্রবণতাই এক একটা দূর্ঘটনার কারণ। গত তিরিশ বছরে কলকাতা শহরের অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলির যদি কোনও ‘ফরেনসিক অডিট’ হয়, তাহলে তো আমাদের নিজেদের লজ্জায় মুখ লোকানোর জায়গা থাকবে না। কখনও প্রোমোটারের লোভ, কখনও পুরানো বাড়িতে বৈদ্যুতিক সংযোগের ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম না মানা এবং কোনও না কোনও স্বার্থে এই সব ‘ভুল’ বা ‘অপরাধ’কে ধামাচাপা দেওয়াই তো আগুন লাগার এবং প্রাণহানির মূল কারণ। কিন্তু কখনও ঝাঁ চকচকে নতুন মল ওঠার ঔজ্জ্বল্যে, আবার কখনও ‘দাদা’দের স্বার্থরক্ষায় সেই সব লাশ হয়ে যাওয়ার খবর আমাদের মাথা থেকে ভ্যানিশ হয়ে যায়।
ভুলে যাওয়ার এই চমৎকার অভ্যাসে আমরা কি আবারও ভুলে যাবো স্ট্র্যান্ড রোডে রেলের দপ্তরে আগুন লাগার বিভীষিকাকে?