‘মোদী-শাহ দায়িত্ব নিতেই আমি বিজেপির ধ্বংসের আভাস পাই’
কিছুদিন আগেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিনহা(Yashwant Sinha)। কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন? বাংলার নির্বাচন এবং বিজেপি সম্পর্কেও বা কী মত তাঁর? দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কলম ধরলেন যশোবন্ত সিনহা:
আমি ১৩ মার্চ কলকাতায় তৃণমূলের কার্যালয়ে(Trinamool Bhavan) তৃণমূল কংগ্রেসে(TMC) যোগদান করেছি। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সহ আরো অনেকে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আমিও সিদ্ধান্তটি হঠাৎ করেই নিয়েছিলাম। আমি সারাজীবন এভাবেই চলেছি। একবার কিছু করব ভাবলে তা তৎক্ষণাৎ করে ফেলি। অন্যদের মতো কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমি পঞ্চায়েতকে তলব করি না। সুতরাং এটি আমার সিদ্ধান্ত, একা আমি নিয়েছি – এবং যদি সেই সিদ্ধান্তে কোন ভুল হয়ে যায় তবে আমার নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দোষ দেওয়ার কোনও কারণ নেই।
বর্তমান বিজেপির (BJP) প্রতি আমার অনাস্থা আমি কখনই গোপন করার চেষ্টা করিনি। মানুষ প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে আমি বিজেপির বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি কেন বিমর্ষ। উত্তর খুব সহজ এবং সোজা। কারণ বর্তমান বিজেপি আর আমি যে বিজেপিতে কয়েক দশক আগে যোগ দিয়েছিলাম সেই বিজেপি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি অটল বিহারী বাজপেয়ী (Atal Behari Vajpayee) এবং এলকে আদবানির(LK Advani) নেতৃত্বে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলাম এবং মোদী-শাহ(Modi -Shah) নেতৃত্বে আসার আগে পর্যন্ত অর্থাৎ ২০১৪-র আগে অবধি দলের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছি। যদিও আমি তাঁদের নেতৃত্বাধীন দল ও সরকার বিরোধী ছিলাম না, তবুও আমার আশংকা ছিল। আমি জানতাম যে আমি সম্ভবত তাদের সাথে দলের নেতৃত্ব দিতে পারব না কারণ তাদের কাজ করার ধরণ নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম।
দুর্ভাগ্যক্রমে, ২০১৪ সালে দিল্লিতে সরকার গঠন হওয়ার সাথে সাথে আমার আশঙ্কা সত্যি হতে শুরু করল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে আমি অনুভব করতে শুরু করলাম এবার তাঁদের কিছু কাজের বিরোধিতা করতে হবে। এরপরেই আমি প্রকাশ্যে তা শুরু করি। পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি; আসলে, আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি দ্রুত ক্ষয় হতে শুরু করে বিজেপি দলের। তাই, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে আমি বিজেপি ত্যাগ করি। আমি মানুষের জন্যে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বুঝতে পেরেছি যে আজকের রাজনীতিতে আপনি কোনও শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম ছাড়া তা করতে পারবেন না। একটি রাজনৈতিক দলে থেকেই কেবল তা সম্ভব।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee) এবং আমি বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় সহকর্মী হিসাবে একসাথে কাজ করেছি। আমি জানি তিনি প্রচুর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এসেছিলেন এবং কেবল একজন যোদ্ধা বলেই তিনি তা করতে পেরেছিলেন। গুরুতর শারীরিক আঘাত পেয়েছিলেন কিন্তু তা তাঁর লড়াইয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। আমি তাই বরাবর তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম। বিরোধীরা যা-ই বলুক না কেন, তিনি গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে অনেক ভালো ভালো কাজ করেছেন। আমি মনে করি যে তিনিই একমাত্র এই মোদী- শাহর মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখেন।
পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল, তবে বাম দলগুলি এবং কংগ্রেসের দুর্বল হওয়ার ফলস্বরূপ, এখন বিজেপি বাংলায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে। লোকসভাতে ১৮ টি লোকসভা আসন পেয়ে বিজেপি ভেবেছে যে বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ করার সময় এসেছে এবং তাই তারা এই রজ্যস্তরের নির্বাচনকে একটি জাতীয় স্তরের নির্বাচন হিসেবে হাইপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাঁচটি রাজ্যে একই সাথে নির্বাচন হচ্ছে। তামিলনাড়ু, কেরল এবং পুদুচেরিতে বিজেপির জেতার কোনও সুযোগ নেই। তারা ইতিমধ্যে অসমের ক্ষমতাসীন দল, সুতরাং সেখানে জিতলেও সেটা কোনও বড় বিষয় হবে না। যদিও আমি যে রিপোর্টগুলি পাচ্ছি তাতে তাদের জেতার সম্ভবনা সেখানেও কম। তাই বাংলাই তাদের মূল লক্ষ্য, এবং সেখানেই বিজেপি রোমেলিয়ান স্টাইলে মনোনিবেশ করছে।
আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্রিটিশ এবং আমেরিকান বাহিনীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উত্তর আফ্রিকাতে জেনারেল রোমেলের সামরিক অভিযানের কথা উল্লেখ করছি। জেনারেল রোমেল প্রায়শই যুদ্ধে ট্যাঙ্কের অভাবে পড়তেন। মরুভূমি যুদ্ধে ট্যাঙ্কগুলিই অগ্রণী ভূমিকা পালন করত। সুতরাং রোমেলের কৌশল ছিল যে কয়েকটি ট্যাঙ্ককে বেশি প্রভাব ফেলতে বৃত্তাকারে ঘোরানো হত। যার ফলে প্রচুর মরুভূমির বালি উড়ত। শত্রুরা মনে করত যে রোমেলের কাছে প্রচুর ট্যাঙ্ক রয়েছে। ফলে তারা লড়াই না করেই পিছু হটত। তবে ফিল্ড মার্শাল মন্টগোমেরি যিনি এল আলামেইনের একটি ট্যাঙ্ক যুদ্ধে তাকে পরাজিত করেছিলেন, তিনি খুব শীঘ্রই বিষয়টি ধরে ফেলেছিলেন। বাকিটা ইতিহাস। বাংলায় বিজেপির কৌশল ঠিক একই রকম। আমদানি করা নেতাদের দিয়ে প্রচুর ধূলিকণা ওড়ানো, জনগণের মধ্যে তাদের শক্তির একটি মিথ্যা ধারণা তৈরি করা এবং সর্বোত্তম হওয়ার আশা জাগানো। রোমেলের মতো তাদেরও পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কোনও কৌশলই তা ঠেকাতে পারবে না। জনগণ সেটা আরও ভাল জানে।
বিজেপি মোদী এবং শাহকে নিয়ে গর্বিত এবং আশাবাদী যে তাঁরা সমস্ত বিরোধীতা কাটিয়ে তাদের বিজয় এনে দেবে। আসলে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিরোধীদের জিজ্ঞেস করা তাদের প্রিয় প্রশ্নটি হল “আমাদের কাছে মোদী আছে, আপনাদের কে আছে?” তবে বাংলায় ছবিটি আলাদা। আমাদের কাছে মমতা আছে, বিজেপির কেউ নেই। তাই তারা বাংলার জনগণকে বলছেন, “আমাদের মোদী এবং শাহকে দেখুন এবং বিজেপির পক্ষে ভোট দিন”। তবে বাংলার মানুষ জানেন যে মোদী বা শাহ কেউই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন না এবং বিজেপির কোনও মুখ্যমন্ত্রীর মুখ নেই। তাই তারা কেবল অন্ধকারে শিস দিচ্ছেন এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। বিজেপি ৮৮ বছরের শ্রীধরনকে কেরলে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পাঠাচ্ছে এবং ৮৮ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং ৮৫ বছর বয়সী জটু লাহিড়ীকে দিয়ে ভোট লড়াচ্ছে। বিজেপির নীতি ছিল ৭৫ বছরের বেশি বয়সীদের ভোটের টিকিট দেওয়া হবে না। সেটিও উলঙ্ঘন করা হয়েছে। তাহলে কেন এলকে আদবানী এবং মুরলি মনোহর জোশীকে বাড়িতে বসে থাকতে হল? তখন এই নীতি কেন ভাঙা হয়নি?
মোদী, এবং বিশেষ করে, শাহ বাংলায় তেমন কিছু জনপ্রিয় না; তাদের সভায় ভিড় দেখে কোনও সিদ্ধান্তে যাবেন না। আমরা জানি আজকাল কীভাবে ভিড় জড়ো করা হয় – আপনি যত বেশি নির্বাচনী বন্ড সংগ্রহ করবেন, তত বেশি ভিড় আপনি একত্রিত করতে পারবেন। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ইন্দিরা গান্ধী কয়েকটি বিশাল সভাতে বক্তব্য রাখেন। তারপরে আমরা ফলাফল সবাই জানি। তিনি আজ বিজেপির নেতৃত্ব দেওয়া এই নেতাদের চেয়ে অনেক বড় নেতা ছিলেন। আসন্ন নির্বাচনে বাংলার মূল ইস্যু “বহিরাগতদের বিরুদ্ধে আমাদের ঘরের মেয়ে”।
গোপাল কৃষ্ণ গোখলে একবার বলেছিলেন “আজ বাংলা যা ভাবছে, ভারত কালকে তা ভাববে”। বাংলার নির্বাচনকে ঘিরে হাইপ তৈরি করেছে বিজেপি। তারা এটিকে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন হিসাবে দেখাতে চায়। আমি তৃণমূলের বিজয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছি।