লোকসভায় বিজেপিকে ভোট দিয়ে ভুল করেছি, মনোরঞ্জনকে বলছে বলাগড়
ছোট ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা চুল, গলায় গামছা, হাতে ক্ষয়ে সরু হয়ে আসা লোহার বালা আর পরনে সস্তা পায়জামা পাঞ্জাবি। ষাটোর্ধ্ব মানুষটিকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে তিনিই প্রার্থী। প্রচারে বেরিয়ে এক গাল হাসি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের কাছে। কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরছেন, আবার কারও সঙ্গে অরাজনৈতিক খোশ গল্পে মজছেন। বাজারের ভিড়ে চাওয়ালা দেখতে পেলে ‘দাও ভাই, একটু চা খাই’ বলে হাত বাড়িয়ে দিতেও তিনি দু’বার ভাবছেন না। প্রচন্ড গরমে নিজেই রাস্তার পাশের কোনও বাড়ির কলিং বেল টিপে বলছেন, ‘বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, একটু জল দেবেন?’ এভাবেই চলছে বলাগড় কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress) প্রার্থী মনোরঞ্জন ব্যাপারীর (Manoranjan Byapari) জনসংযোগ।
সময় তখন ভোর সাড়ে ছ’টা। পরিকল্পনা মাফিক গুপ্তিপাড়ার বড়বাজারে মনোরঞ্জনবাবু। সঙ্গে অনেক কর্মী থাকলেও মাত্র দু’টি জোড়াফুলের পতাকা। অতিরিক্ত জাঁকজমক এড়ানোই লক্ষ্য। যেন ভোট প্রচার নয়, সক্কাল সক্কাল তিনি বেরিয়েছেন আর পাঁচজনের মত কানকো টিপে দরাদরি করে মাছ কিনবেন বলে। বড়বাজারে তখন শতাধিক মানুষের ভিড়। একে একে ক্রেতা, বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলছেন মনোরঞ্জনবাবু। শুনছেন তাঁদের কথা, পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছেন। কখনও আবার নিজেই বাতলে দিচ্ছেন সমাধান। যেখানেই দাঁড়াচ্ছেন জমে যাচ্ছে ভিড়। হঠাৎই ‘আরে আপনি তো আমাদের মতই সাধারণ’— বলে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন এক চাওয়ালা। হাতের ফ্লাস্ক আর বিস্কুট ভর্তি ব্যাগটা কোনওমতে মাটিতে রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন প্রার্থীকে। আবেগে তখন কী বলবেন, ভেবে পাচ্ছেন না মনোরঞ্জনবাবু। ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে মৃদু গলায় বললেন, ‘দাও ভাই, একটু চা খাই’। কিছুক্ষণের চা বিরতি শেষে ফের শুরু করলেন প্রচার। গলায় থাকা গামছায় হাত আর মুখের ঘাম মুছে যখন প্রচার শেষ করলেন তখন ঘড়িতে সময় দশটা ছুঁই ছুঁই। বাইরে তখন বেশ রোদের তেজ। বাজারের পার্টি অফিসে দলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে বৈঠকের মাঝে চলে এল গরম কচুড়ি আর আলুর তরকারি। শোনালেন জীবনের কথা, লড়াইয়ের কথা। ‘বছর তিনেকের আমি তখন। বাবা চলে আসেন ওপার বাংলা থেকে। একাধিক রিফিউজি ক্যাম্প ঘুরে বেড়ে ওঠা আমার। পড়াশোনা নিজের উপার্জিত পয়সায়। কখনও রিকশা চালিয়েছি, কখনও রান্নার কাজ করেছি। যখন যেমন কাজ পেয়েছি, তা করেই অন্নসংস্থান হয়ে গিয়েছে। লেখালেখির পালা সামলে সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী রাজনীতিতে আসত না। যদি না দেখতাম, ওই গুজরাতি বেনিয়ারা আমার মাতৃভূমি দখলে উদ্যত। ১৭৫৭ সালের এক ভুলে ২০০ বছরের গোলামি টেনেছি। জীবন থাকতে আর নয়। বাংলা থাকুক বাঙালির হাতেই। আরও সমৃদ্ধ হোক বাংলার সংস্কৃতি।’
কর্মসূচি অনুযায়ী টোটোয় চেপে যখন প্রচার শুরু হল, তখন সূর্য প্রায় মধ্য গগনে। গুপ্তিপাড়ার একাধিক এলাকা ঘুরে হুডখোলা সবুজ টোটো এগিয়ে যাচ্ছে বেহুলা স্টেশনের দিকে। বিন্ধ্যবাসিনীতলায় শঙ্খ-উলুধ্বনিতে প্রার্থীকে বরণ করলেন জনা পঞ্চাশেক মহিলা। কপাল জুড়ে বিজয় তিলকের প্রতীক স্বরূপ টেনে দিলেন সিঁদুর।
এদিকে, গরম যত বাড়ছে ততই প্রচার ঝাঁজালো হচ্ছে। ক্ষুরধার হচ্ছে। কোথাও কোথাও মাইক হাতে নিয়ে নিজেই তুলোধোনা করলেন বিজেপিকে। উঠে এল ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপির দেওয়া একাধিক প্রতিশ্রুতি, যার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। বাবুডাঙা, নারায়ণপুর কলোনি আদিবাসী গ্রামে ‘দলিত সাহিত্যিক’-এর সেই বক্তব্য শুনতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এলেন মহিলা, পুরুষরা। বক্তব্য যখন শেষ হল তখন সামনের ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন মাঝবয়সি ছিপছিপে চেহারার এক যুবক। স্বপন মণ্ডল ওরফে দুখিরাম নামের সেই যুবক মনোরঞ্জনবাবুর দিকে তাকিয়ে অকপটে বললেন, ‘লোকসভায় ভুল করেছি পদ্মে ছাপ দিয়ে। কেউ খোঁজ নিতে আসেনি আর। তাও এই সেদিন অবধি দেওয়াল লিখে এসেছি ওদের হয়ে। চিঁড়ে ভেজানো কথায় বিশ্বাস আর নয়। দিন একটা জোড়াফুলের পতাকা। লড়াইটা আমি বাংলার মেয়ের জন্যই করতে চাই।’