বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণ – জানেন কি সেই তালিকা?
বাঙালির ঘরে ঘরে, বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকে। আর এই পার্বণ বা উত্সব মানেই নতুন আনন্দে গা ভাসিয়ে দেওয়া। কিন্তু জানেন কি এই তেরো পার্বণ কোনগুলি?
আসুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক এই পার্বণগুলির তালিকা:
চৈত্রমাসে চড়ক পুজো গাজনে বাঁধ ভারা
বৈশাখ মাসে দেয় সকল তুলসীগাছে ঝারা
জ্যৈষ্ঠমাসে ষষ্ঠীবাঁটা জামাই আনাআনি
আষাঢ় মাসে রথযাত্রা দড়া টানাটানি
শ্রাবণ মাসে ঢেলাফেলা হয় চড়চড়ি
ভাদ্র মাসে টকপান্তা খান মনসা বুড়ি
আশ্বিনে অম্বিকা পুজো কাটে মোষ পাঁঠা
কার্তিকে কালিকা পুজো, ভাইদ্বিতীয়ার ফোঁটা
অঘ্রানে নবান্ন নূতন ধান কেটে
পৌষ মাসে বাউনি বাঁধা ঘরে ঘরে পিঠে
মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী ছেলের হাতেখড়ি
ফাল্গুন মাসে দোলযাত্রা ফাগ ছড়াছড়ি
চৈত্রমাসের চড়ক পুজো
এই পুজোকে অনেকে আবার নীল পুজোও বলেন। এই পুজোর বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হল কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির ওপর লাফানো, বাণ ফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পুজো করা।
বৈশাখ মাসে তুলসীগাছে ঝারা বাঁধা
‘তুলসী তুলসী বৃন্দাবন, তুলসী তুমি নারায়ণ তোমার মাথায় ঢালি জল, অন্তিমকালে দিও স্থল।’
আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ ও সংসার সুখ শান্তি বৃদ্ধির জন্য প্রতিদিন সকালে স্নান করে তুলসী গাছে জল নিবেদন করার সাথে গৃহস্থ বধূরা এই মন্ত্রটি উচ্চারণ করে থাকেন।
জ্যৈষ্ঠমাসে জামাইষষ্ঠী
মিষ্টির হাঁড়ি হাতে ফিনফিনে সাদা মসলিনের পাঞ্জাবি আর মালকোচা মারা ধুতিতে শ্বশুরঘর আলো করা জামাই বাবাজি। পঞ্চব্যঞ্জনে সাজনো জামাইয়ের পাত। আম-কাঁঠাল, ইলিশের পেটি কিংবা কচি পাঠাঁর মাংস সহযোগে ভুরিভোজ এটাই বাঙালির জামাইষষ্ঠী।
আষাঢ় মাসে রথযাত্রা
কথিত আছে মথুরা ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন জগন্নাথ। সেকারণে তৈরি করা হয়েছিল রথ। কিন্তু ভক্তরা যখন সেই রথ টানতে শুরু করেন, তখন কিছুতেই নড়েনি রথের চাকা। শেষে রাজা এসে যখন রথের রশিতে টান দেন তখন রথ চলতে শুরু করে। এভাবেই শুরু হয়েছিল পুরীর রথযাত্রা।
শ্রাবণ মাসে শিবের ব্রত
গোটা শ্রাবণ মাস ধরেই শিবের ব্রত পালন করলে৷ জীবনে আটকে থাকা কাজ সম্পন্ন হয়, সংসারে সুখ ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, অর্থনৈতিক প্রতিকূলতামুক্ত জীবন হয়ে ওঠে সুন্দর ৷ এক কথায় জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে শিবের ব্রত পালনের মাধ্যমে।
ভাদ্র মাসে মনসা পুজো
গ্রাম বাংলায় মাটির মুর্তি গড়ে বা থানে মনসা পুজো হয়। সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে, সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশ্যে তার পুজো করা হয়। মনসা ঘট স্থাপন করে পুজো করা হয়।
আশ্বিনে অম্বিকা পুজো
এই পুজো উপলক্ষে সর্বত্র মোষ বলি দেওয়ার রীতি চলে আসছে। বলির পর মোষের কাটা মাথার সামনে মোষেরই সামনের দুটি পা আড়াআড়িভাবে রাখা হয়। মোষের কাটা মাথার উপর রাখা হয় একটি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ। বলিপ্রদত্ত মোষটির নাম হয় ‘দেবরাপো’। উল্লেখযােগ্য দুর্গা দশমীতে এমনই দেবীর ভােগে পান্তা ভাত, কচুশাক ও ঘী দেওয়ার রীতি আছে।
কার্তিকে কালিকা পুজো
কালী হচ্ছেন দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা। পুরাণ ও তন্ত্রে বহু তথ্য অনুযায়ী দেবাসুরের যুদ্ধে পরাজিত করতে দেবগণের স্তুতিতে আদ্যাশক্তি ভগবতীর দেহকোষ থেকে দেবী কৌষিকী আবির্ভূত হন। তখন ভগবতীদেবী কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন বলে তাঁর নাম হয় কালী বা কালিকা। তিনি শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই দানবকে বধ করেছিলেন।
ভাইদ্বিতীয়ার ফোঁটা
পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ‘ভাইদুজ’ নামেও পরিচিত। বিজয়া দশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসবের আরও একটি নাম হল ‘যমদ্বিতীয়া’। ভাই-বোনের ভালবাসার বন্ধন অনন্তকাল অটুট রাখার জন্য বংশপরম্পরায় এই বিশেষ উৎসব পালিত হয়।
অঘ্রানে নবান্ন
নবান্ন শস্যভিত্তিক একটি লোকউৎসব। অঘ্রান মাসে যখন নতুন ধান ওঠে তখন এই উৎসব পালিত হয়। অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি, সন্তান ও পশুসম্পদ কামনা এ উৎসব প্রচলনের প্রধান কারণ।
পৌষ মাসে বাউনি
পৌষ মাসে বাঙালিরা যে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পিঠেপুলি উৎসব বা বাউনি। নতুন গুড় ও চাল দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু নানারকম পিঠেপুলি।
মাঘ মাসে হাতেখড়ি
প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী বিদ্যার দেবী সরস্বতীর সামনে এদিন শিশুর হাতে খড়িমাটি ধরিয়ে প্রথম তাকে শ্লেটে লিখতে শেখানো হয়। এজন্যই এ অনুষ্ঠানটির নাম হয়েছে হাতেখড়ি। মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে এটি করা হয়।
ফাল্গুন মাসে দোলযাত্রা
বসন্তকাল মানেই হল তো দোলযাত্রা। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির বা গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়।
(তথ্যসূত্র: অলিনগরের গোলকধাঁধা, সৌগত বসু)