নন্দলালের তুলির টানে সমৃদ্ধ ভারত
ভারত তখন সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে। বাবা সাহেব আম্বেদকর রচনা করে ফেলেছেন ভারতের সংবিধান। কিন্তু শুধু লেখাই কি থাকবে বিশাল বই জুড়ে। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু একটু অন্যকিছু করার ভাবনাচিন্তা করছিলেন। তিনি বিখ্যাত এক চিত্রশিল্পীকে বলেন সংবিধানের বইয়ের জন্য কিছু ছবি এঁকে দিতে। নেহরুর ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন শিল্পী। মোট বাইশটি ছবি আঁকেন ভারতের সংবিধানের পাতায়।
বিখ্যাত সেই চিত্রশিল্পীর নাম নন্দলাল বসু | তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব | এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেন কলাভবনেরই কয়েকজন ছাত্র। নন্দলালের অনবদ্য চিত্রশৈলীতে সংবিধানের পৃষ্ঠাগুলিতে ফুটে উঠেছে মহেঞ্জোদারোর সিলমোহর, রামায়ণ, মহাভারত, গুরুকূল শিক্ষা, বুদ্ধের জীবন ও সম্রাট অশোকের বৌদ্ধধর্ম-প্রচার, মহাবীরের কথা, গুপ্তযুগ, বিক্রমাদিত্যের সভা, সম্রাট আকবর ও মুঘল স্থাপত্য, শিবাজি, গুরুগোবিন্দ সিং, রানি লক্ষ্মীবাই, টিপু সুলতান, গান্ধিজির আন্দোলন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই সহ ভারতের পাহাড়, সমুদ্র ও মরুভূমির বিচিত্র সৌন্দর্যের রূপ। এছাড়াও তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর অনুরোধে ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী সহ বিভিন্ন পুরস্কারের স্কেচ তৈরি করেন।
নন্দলাল বসুর জন্ম ১৮৮২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ববিহারের খড়গপুরে। তাঁর পৈতৃক নিবাস হুগলি জেলায়। পিতা পূর্ণচন্দ্র বসু হাভেলি-খড়গপুরে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাতা ক্ষেত্রমণী দেবী। ছেলেবেলা থেকেই নন্দলাল কোনওরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই দেবদেবীর মূর্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পুতুল তৈরি করতেন। আকর্ষণ শুধুই আঁকা এবং শিল্পকে ঘিরে। অমনোযোগিতার কারণে এফ.এ পরীক্ষায় পর পর দুবার ফেল করেছিলেন।
বাবা পূর্ণচন্দ্র বসু ও মা ক্ষেত্রমণি দেবী ছেলের পড়াশোনায় এমন অনীহা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। শেষে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহায্যে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান তিনি। সেই শুরু তাঁর জয় যাত্রা। এখানকার ছাত্র থাকাকালীন তিনি কর্ণের সূর্যস্তব, গরুড়স্তম্ভতলে শ্রীচৈতন্য, কৈকেয়ী, শিবমতি, নৌবিহার প্রভৃতি ছবি এঁকে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেন। ভারতীয় শিল্পের ধারাটাই বদলে দিলেন তিনি। পড়াশোনায় চূড়ান্ত অমনোযোগী ফেল করা ছাত্রই শান্তিনিকেতনের কলাভবনের অধক্ষ্য হন।
তিনি কর্মজীবনের শুরুতে পাটনা, রাজগির, বুদ্ধগয়া, বারাণসী, দিল্লী, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন, এলাহাবাদ ভ্রমণ করে উত্তর ভারতের শিল্প ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হন। প্রায় একই সময়ে পুরী থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করেন এবং কোণারকের সূর্য মন্দির তাঁকে প্রভাবিত করে। ১৯২১ সালে তিনি বাঘ গুহার নষ্ট হয়ে যাওয়া চিত্রগুলি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ভগিনী নিবেদিতার হিন্দু-বৌদ্ধ পুরাকাহিনী বইটির অঙ্গসজ্জা করেন এবং ঠাকুরবাড়ির চিত্র কলার তালিকা তৈরীতেও সাহায্য করেন।
১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিচিত্রা সংঘে তিনি শিল্পকলার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৫-৩৭ সালে পর পর তিন বছর তিনি কংগ্রসের বার্ষিক সম্মেলনে শিল্প প্রদর্শনী ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত হরিপুরা সম্মেলনে তিনি লোকচিত্রের ধারাবাহী ৮৩টি পট প্রদর্শন করেন যা হরিপুরা পট নামে খ্যাত। ১৯৪৩ সালে তিনি বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলঙ্কৃত করার দায়িত্ব লাভ করেন।
এই কীর্তিমন্দিরের চারিদিকের এবং শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনের দেয়ালচিত্র নন্দলাল বসুকে খ্যাতিমান করে তুলে। তাঁর আঁকা ছোট ছোট ছবিগুলোতেও তাঁর প্রতিভার এবং স্বাতন্ত্রের পরিচয় মেলে। শেষ জীবনে নন্দলাল বসু তুলি-কালি এবং ছাপচিত্রের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন এবং এক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দেন। রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠের ছবিগুলিও তাঁর আঁকা।
১৯৫২ সালে কাশী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিক ডিলিট. ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৫৬ সালে তিনি নয়া দিল্লীর ললিতকলা আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে তিনি কলাভবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস পদ প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশীকোত্তম উপাধি এবং ১৯৫৪ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৬৬ সালের ১৬ই এপ্রিল আজকের দিনেই তিনি শান্তিনিকেতনে পরলোকগমন করেন।